Advertisement
E-Paper

ঘাড়ে একটা রদ্দা আর তলপেটে সজোরে লাথি.

হাইড রোডের কারখানা-চত্বরে গাড়ি থেকে নামতেই এমন কিল-চড়-লাথির অভ্যর্থনা শুরু হবে ভাবতে পারিনি! আমার সহকর্মী চিত্রসাংবাদিক শুভাশিস ভট্টাচার্য ভিড় দেখে সবে ক্যামেরা খুলতে গিয়েছেন, আর তখনই তেড়িয়া ভঙ্গিতে ওঁর উপরে চড়াও হল ক’জন ষণ্ডামার্কা লোক।

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪২
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

হাইড রোডের কারখানা-চত্বরে গাড়ি থেকে নামতেই এমন কিল-চড়-লাথির অভ্যর্থনা শুরু হবে ভাবতে পারিনি!

আমার সহকর্মী চিত্রসাংবাদিক শুভাশিস ভট্টাচার্য ভিড় দেখে সবে ক্যামেরা খুলতে গিয়েছেন, আর তখনই তেড়িয়া ভঙ্গিতে ওঁর উপরে চড়াও হল ক’জন ষণ্ডামার্কা লোক। ওঁকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারতে লাগল ওরা। শুভাশিস শুধু শক্ত করে ক্যামেরাটা ধরে থাকলেন। কী করব, কী করে ওঁকে বাঁচাব, বুঝতে পারছিলাম না। খাকি উর্দিধারী ক’জন লোক এর মধ্যেই কারখানা থেকে চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিলেন (পরে বুঝতে পারি ওঁরা বন্দরের নিরাপত্তাকর্মী)। ‘দাদা দেখুন’ বলে ওঁদের সাহায্য চাইতে গেলাম। ওঁরা শশব্যস্ত ভঙ্গিতে ‘আমরা কিছু জানি না’ বলে দ্রুত পায়ে চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

শুভাশিস সকালেই ওই তল্লাট থেকে একবার ঘুরে এসেছিলেন। তখন কারখানার লোহার গেট বন্ধ ছিল। তাতে বন্দরের নোটিস লটকানো। গোলমালের খবর পেয়ে বেলা সওয়া ১০টা নাগাদ দু’জনে মিলে ফের ওখানে যাই। শুভাশিসের ক্যামেরায় আগে ধরা পড়েছিল, খাকি উর্দিধারীরা কারখানা-চত্বর পাহারা দিচ্ছেন। আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি প্রধানত রংবেরঙের টি-শার্ট, হাফপ্যান্টধারী ষণ্ডাবাহিনীই এলাকার দখল নিয়েছে।

লোকগুলো শুভাশিসকে মারতে মারতে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে এ বার মোবাইলটা বের করে আমি ছবি তোলার চেষ্টা করি! সঙ্গে সঙ্গে ‘কে রে তুই’ বলে আমাকে অকথ্য গালিগালাজ করা শুরু হল। প্রথমেই কে যেন মোবাইলটা কেড়ে নিল হাত থেকে। তার পরই পিছন থেকে ঘাড়ের উপরে একটা রদ্দা আর তলপেটে সজোরে লাথি! যন্ত্রণায় প্রায় মাটিতে বসে পড়ছিলাম, দেখি পিঠে-ঘাড়ে দমাদ্দম মারতে-মারতে ওরা শুভাশিসকে ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শুভাশিস মার খেতে খেতেই একবার পিছনে ফিরে আমায় জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। ওরা ওঁকে মারতে মারতে কারখানা-চত্বরের একটা দেওয়ালে ঠেসে ধরল। বুঝতে পারলাম, ওঁর ক্যামেরাটা কেড়ে নেওয়াই ওদের লক্ষ্য। কুৎসিত গালাগাল দিতে দিতে এক পাল ছোকরা হাতে বাঁশ আর একটা ভাঙা চেয়ার নিয়ে শুভাশিসের দিকে তেড়ে আসছিল। ‘আরে মরে যাবে তো’ বলে লম্বা মতো একটা লোক ভাগ্যিস, ওদের থামাল! এ দিকে আমার উপরেও ঘুষি-লাথির বিরাম নেই। জন্মে অবধি কারও সঙ্গে মারপিট করার অভিজ্ঞতা নেই আমার। আর কব্জির জোরে এই ঠ্যাঙাড়েদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অগত্যা রগের দু’পাশে হাত দিয়ে কোনও মতে প্রাণে বাঁচবার চেষ্টা করছিলাম।

ধাক্কাধাক্কি-পেটানির ঠেলায় আমি আর শুভাশিস কখনও কাছাকাছি আসছি, তো কখনও ছিটকে যাচ্ছি। এক বার ‘ভাগ শালা’ বলে ক’জন আমায় কারখানার বাইরে বের করে দিল। মার খেতে খেতেই মনে পড়ল, মোবাইলটা তো উদ্ধার করতে হবে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উল্টো দিক থেকে মারের তোড়ে ফের কারখানার ভিতরে ঢুকে যাই। মার খেতে খেতে দু’-তিনবার এ ভাবেই কারখানায় ঢুকছি আর বেরোচ্ছি! শুভাশিসকেও দেখতে পাচ্ছি না! ক্রমশ প্রাণের ভয় কাবু করে ফেলছে। এই অবস্থায় কারা যেন ঠেলে কারখানার ভিতরে একটা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিল।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন

কারখানার ভিতরে যে শ্যুটিং হয় তা তো জানি! আয়নাওয়ালা, এসি ঘরটা দেখে মেকআপ রুম বলে মনে হচ্ছিল। আচমকাই দেখি— এত ক্ষণ যারা মারছিল, তারা হঠাৎ ভোল পাল্টে আমার প্যান্টের ধুলোটুলো ঝেড়ে দিয়ে ‘আসুন, বসুন’ করে ভিতরে বসাতে চাইছে। শুভাশিসকেও ওই ঘরেই দেখতে পেলাম। ওঁর ক্যামেরা-চশমা সব গায়েব।

এর পরে প্রায় ৪০ মিনিটের বন্দিদশা সেই মেকআপের কুঠুরিতে! বুঝতে পারছিলাম যে, ওদের মাথায় ঢুকেছে যে সংবাদমাধ্যমকে মারধর করাটা ভুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও আমার মোবাইল, শুভাশিসের ক্যামেরা কিচ্ছু ফেরত পাইনি। সাহস করে বলতে থাকি, ‘‘আমাদের কাজের জিনিসগুলো এখনই ফেরত দিন।’’ ততক্ষণে এবিপি আনন্দ-এর সাংবাদিক ময়ূখ ঠাকুর চক্রবর্তী, পার্থপ্রতিম ঘোষ ও চিত্রসাংবাদিক পার্থসারথি চক্রবর্তীকেও মারতে মারতে ওই ঘরে ঢোকানো হয়েছে। ওঁদেরও মোবাইল, ক্যামেরা সব কেড়ে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে! পার্থপ্রতিম দেখি, ধুঁকছেন। ওঁকেও পাইপের বাড়ি বেধড়ক মারা হয়েছে।

কয়েক জন লোক অবশ্য পরিস্থিতি ঠান্ডা করার চে‌ষ্টা করছিল। আমাদের চা-জল খাওয়াতে চাইছিল (পরে অফিসে এসে শুনি, ওই সময় আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকের কাছে তিন বার ফোন করেছিলেন ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা। তিনি নাকি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর কিছু টেকনিশিয়ান উত্তেজনাবশে এমন করে ফেলেছে!)। জটলার মধ্যে টিভি সিরিয়ালের চেনা মুখ এক অভিনেতাকেও দেখলাম। কোনও কথা না-বলে আমরা শুধু আমাদের ক্যামেরা আর মোবাইল ফেরত চাইলাম। ওরা বোঝানোর চেষ্টা করছিল, যারা মেরেছে তারা বাইরের লোক। ওরা তাদের চেনে না। কিন্তু মোবাইলটা ফেরত দেওয়ার আগে মোবাইলে তোলা মারপিটের দু’-চারটে ছবি কিন্তু মুছে দিল ওরাই। আমাদের সামনেই এবিপি আনন্দ-র ক্যামেরা থেকেও ওরা ছবি মুছতে লাগল। আমরা বললাম, ‘‘বাইরের লোক গোলমাল করেছে তো ছবি কেন মুছছেন!’’ ওরা ‘ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন’ বলে ছবি ‘ডিলিট’ করতে লাগল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে টের পেলাম, নেটওয়র্ক নেই। সিমটা ওরা বার করে নিয়েছে। সাধ্যসাধনা করে সিমটা ফেরত পেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে এক সহকর্মীকে হোয়াট্সঅ্যাপ করে বললাম, ‘আমাদের মারধর করে ওরা আটকে রেখেছে!’

তত ক্ষণে শুভাশিসও ওঁর ক্যামেরা ফেরত পেয়েছেন। ক্যামেরার লেন্স দুমড়ে গিয়েছে। ব্যাটারি, চিপ কিচ্ছু নেই। চিপ ফেরত পাওয়া গেল আরও একটু পরে। শুভাশিসের চশমাটা অবশ্য পাওয়া যায়নি। আমরা বললাম, ‘‘আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না! আমাদের বেরোতে দিন।’’ ওরা রাস্তা ছেড়ে দিল। মারের চোটে পিঠ টনটন করছে। এবিপি আনন্দর সাংবাদিকরা আর শুভাশিসেরও খুবই কাহিল দশা! কিন্তু সবার আগে পুলিশের কাছে অভিযোগ লেখাতে হবে। কারখানার সামনে থেকে খানিকটা এগিয়ে গাড়িতে বসে আমরা তারাতলা থানার দিকে রওনা হলাম। শুভাশিস তারই মধ্যে এক ফাঁকে ক্যামেরায় চিপ-ব্যাটারি ভরে আমার দিকে চোখের ইশারা করলেন! নাহ্, সকালবেলায় তোলা কারখানা-চত্বরের ছবিগুলো সব ওরা মুছতে পারেনি!

bandar area kolkata port venkatesh films brutally beatne abp group journalist abp ananda journalist mehbub kader choudhury shubhashis bhattacharya hyde road srikanta mohta abpnewsletters MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy