Advertisement
E-Paper

দক্ষিণের কড়চা

‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না— অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য৷ এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ৷ কিন্তু বাংলা নাট্যের উজ্জ্বল আলোর যে শহর কলকাতা, সেখানে এখনও তাঁকে নিয়ে তেমন কোনও সাড়াশব্দ নেই৷

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০০:০১

ফের মরা চাঁদ
আজ বিজনে

‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না— অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য৷ এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ৷ কিন্তু বাংলা নাট্যের উজ্জ্বল আলোর যে শহর কলকাতা, সেখানে এখনও তাঁকে নিয়ে তেমন কোনও সাড়াশব্দ নেই
গ্রামের কথা, জেলার মানুষের কথা বিজনের সমগ্র নাট্যজীবন জুড়ে৷ তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক নবান্ন-এর প্লট সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই বলেছেন— ‘একদিন ফেরার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কী হচ্ছে?’ তাঁর আর এক বিখ্যাত নাটক ‘মরাচাঁদ’ দিনাজপুরের এক দৃষ্টিহীন দোতারাবাদক টগর অধিকারীর জীবনের ছায়ায় লেখা৷ সে নাটকের ভূমিকায় বিজন নিজেই জানিয়েছেন সে কথা, ‘একদিন ভাওয়াইয়া ও চটকা গানের রূপ ও চলন নিয়ে কথা হচ্ছে— হঠাৎ বিষণ্ণ ভাওয়াইয়ার একটি মূর্ছনা দোতারায় তুলে টগর অধিকারী সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, বিজনবাবু আমার যে তা এট্টা বিয়া করা লাগে... টগর বিয়েও একটা করেছিল৷ উত্তরবঙ্গেরই পল্লিগ্রামের একটি সুন্দরী মেয়ে৷ সংসারও একটা পেতেছিল দোতারা সম্বল করে৷ কিন্তু টগর অধিকারীর সুখের সংসার বেশিদিন টেঁকেনি৷ ...‌সেই দোতারা নাকি চিরকালের জন্য থেমে গেছে৷ মারা গেছে টগর অধিকারী৷’

জীবন থেকে নেওয়া সেই নাটক ‘মরাচাঁদ’ তাঁর জন্মশতবর্ষে একটি কর্মশালার মাধ্যমে অভিনয় করছে সাঁইথিয়ার ‘ওয়েক আপ’৷ বীরভূমের সাঁইথিয়া, বোলপুর, সিউড়ি, রামপুরহাটের পঞ্চাশ জনের বেশি অভিনেতাকে নিয়ে কর্মশালাটির পরিচালক ছিলেন অভী চক্রবর্তী৷ সহায়তায় ছিলেন ‘ওয়েক আপ’-এর পান্নালাল ভট্টাচার্য ও তীর্থজিত ঘোষ৷ বহুরূপী পত্রিকার মে ২০১৫ সংখ্যায় শতবর্ষে বিজন ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখেছেন আশিস পাঠক, ‘বিশিষ্ট বিজন ব্যক্তিসত্য থেকে নাট্যসত্য’৷ সঙ্গে ‘মরা চাঁদ’ নাটকের একটি দৃশ্য ও ইন্দ্রপ্রমিত রায়ের স্কেচে বিজন ভট্টাচার্য৷

কাজীর বাড়ি

শেষ জীবনে বিস্মৃতি তাঁকে কেড়ে নিয়েছিল জীবন থেকে। ও পারে চলে যাওয়া কবিকে ভুলতেও যেন কিছুটা তৎপর হয়ে উঠেছিল এই পার। কিন্তু তাঁর গান রয়ে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে অসংখ্য সুর। আকাশবাণীর স্মৃতি। আর সঞ্চিতা ভরা আগুন। মৃত্যুর পরে চল্লিশ বছর হতে চলল। আর যদি তত কেউ মনে না-ও রাখে, বর্ধমানের চুরুলিয়া কাজী নজরুলকে ভোলে কী করে? কবি শুয়ে আছেন ঢাকায়। কিন্তু সেখান থেকে গোরের মাটি এনে রাখা হয়েছে চুরুলিয়ায় তাঁর জন্মভিটেয়। মঙ্গলবার নজরুলের জন্মদিনে সেই সমাধিতে ফুল পড়ল। প্রভাতফেরি বের করল নজরুল আকাদেমি। কবির পূর্ণাঙ্গ মূর্তির উন্মোচনও হল। প্রতি বারের মতো মেলা তো শুরু হয়েইছে। শেষ হবে ১ জুন।

গূঢ় অন্ধকার

ছিঁড়ে যাওয়া জল দিয়ে
দাগ কাটি তরুণী নাবিকের গলায়।

চোরা, কখনও উচ্চকিত যৌনতার উদ্‌যাপন যেন। কিছুটা আরক্ত, কিছুটা অস্থির, কিছুটা বিষণ্ণ। কখনও ভাঙা আরশির পাশে, কখনও গঙ্গার ঘাটে উদাসীন বসে থাকা। আর ভাবা—
সে কি গালে অভ্র মেখেছে?
বিষাক্ত এই সব বিকেল
শুধু উপহার দিতে জানে
হিংস্রতা প্রদেশের প্রজাপতি।
’’
কিছুটা এ রকমই সৌমাভ দত্তের কবিতা। প্রায়ই রোদ, গাছ, শিকড়, মেঘ, নেশা আর অপেক্ষা জায়গা বদলাবদলি করে বসে। ফিসফিস করে বলে ‘মৃত মানুষ কৈফিয়ত চায় না এখনও।’ আরও নানা প্রসঙ্গের আসা-যাওয়া থাকে। কখনও তা আটোঁ, আতিশয্যে আলগা কখনও। ভালবাসা এলেই কিন্তু তিতাসে ভেসে যাওয়া পাগলা নাওটির মতো ফুলে উঠতে থাকে পাল। ছিপছিপে মলাটের অন্ধকারের পাতাবাহার (মনফকিরা) বইয়ে ছড়িয়ে তারই সাক্ষ্য।

রাঙা পথে

যে পথে আসা-যাওয়া, সে পথের নামেই পত্রিকার নাম— লালডহর৷ কিন্তু সে তো নিছক আবেগ, বাঙালির সাহিত্য-অসুখ? ‘না, মুকুটমণিপুর জলাধারের পাশের আদিবাসী গ্রামগুলোর মধ্যের লাল মাটির রাস্তা দিয়ে পড়াশোনা করতে গেছি, কর্মজীবনেও সে পথ ছিল আমার সঙ্গী৷ কিন্তু শুধু পথ তো নয়, এই অঞ্চল আর তার লোকসংস্কৃতি আমাকে টেনেছে বারবার৷ তাই পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় এই অঞ্চলের লোকশিল্পীদের দিয়ে লেখাই,'' বলছেন পত্রিকার সম্পাদক, পুরুলিয়ার লৌলাড়া কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়৷ কথাটা ঠিকও৷ এ বার ঝুমুরশিল্পী অবনী সিংমুড়ার গান নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ জঙ্গলমহলের ঘাঁটুগান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন নকুল মাহাতো৷ তার সঙ্গে অঞ্চলের পুরাকীর্তি৷ দামোদর-দ্বারকেশ্বর তীরের জৈন পুরাকীর্তির খোঁজ করেছেন অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়৷

কিঙ্করের ঘর

রামকিঙ্কর বেইজের ৩০টি ভাস্কর্য এবং দেড়শোটি স্কেচ ও পেইন্টিংয়ের ছবি রাখা হয়েছে সাজিয়ে। রয়েছে শিল্পীর জন্মস্থান, বাঁকুড়ার যুগিপাড়ার মাটি এবং আরও নানা টুকিটাকি। বিশেষ আকর্ষণ রামকিঙ্করকে নিয়ে চিত্রায়িত জীবনী। দু’দশকের চেষ্টায় এমনই একটি প্রদর্শশালা, ‘রামকিঙ্কর কক্ষ’ গড়ে তুলেছে ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমি। ২০১১ সালে ঝাড়গ্রাম শহরে সংস্থার কার্যালয়ের দোতলায় স্থায়ী ভাবে চালু এই গ্যালারি এখন জঙ্গলমহলের অন্যতম দ্রষ্টব্য। যদিও রামকিঙ্করের জন্মকর্ম কোনও কিছুই এই শহরে নয়, দিল্লির ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি ছাড়া আর যেখানে তাঁর কাজ রাখা আছে তা শান্তিনিকেতন, তবু নবীন প্রজন্মের শিল্পীদের এই প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে বৈকি। গত ২৫ মে সোমবার, রামকিঙ্করের ১০৯তম জন্মদিনে সংস্থার রামকিঙ্কর মঞ্চে দিনভর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়। দীর্ঘ এক ক্যানভাসে ছবি আঁকে শতাধিক খুদে শিল্পী। সূচনা হয় শিশু উত্‌সবের। সেখানে বিভিন্ন শৈলির অঙ্কন কর্মশালারও আয়োজন করা হয়েছে। উৎসব চলবে ১৯ জুন পর্যন্ত।

বাজ-কাহিনি

ধুলোকাদায় অচেনা হয়ে ওঠা ল্যান্ডরোভার থেকে খরখরে স্বরে মাঝে-মাঝেই ককিয়ে উঠছে ম্যানপ্যাক—‘সিএফ কলিং বাজ-৮...রেসপন্ড ইমিডিয়েটলি বাজ-৮..।’ সামনে চরাচর জুড়ে জ্যোৎস্না ভাসা ধান খেত। কোমর সমান উঁচু সেই নিবিড় খেতের মাঝে তিনি এবং সে। ম্যানপ্যাকে বড় কর্তার ডাকে সাড়া দেওয়ার সময়ই ছিল না তাঁর। কোচবিহারের সেই রাতটা এখনও মনে আছে কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তামাম বন দফতর যাঁকে ‘বাজ-৮’ স্কোয়াড লিডার হিসেবেই চেনে। জলপাই সবুজ ছোপ মিলিটারি ফ্যাটিগটা কোমর থেকে তুলে কাঞ্চন দেখাচ্ছেন চিতাবাঘের ধারাল নখের সেই গভীর স্মৃতি। বলছেন, ‘‘চিতাবাঘটা গোটা তিনেক মানুষ মারার পরে সে বার তলব করা হয়েছিল আমাকে। কোচবিহারের থানেশ্বরে সেই রাতে জনা চারেক সঙ্গী নিয়ে মাঠে নামতেই বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপরে। দাগটা এখনও রয়ে গিয়েছে।’’ শুধু শরীরে নয়, মনেও এমন বহু দাগ রয়ে গিয়েছে তাঁর। বলছেন, ‘‘ট্রিগারে হাত পড়েছে বহু বার। কিন্তু অমন সুন্দর একটা প্রাণীকে মারতে ভাল লাগে? দিন কয়েক মেঘলা হয়ে থাকে মন।’’ যাঁর আস্তিনে রয়ে গিয়েছে— ‘রোগ’ হাতি থেকে চিতাবাঘ, বাইসন থেকে চোরাশিকারি এমনকী বক্সার জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ানো উগ্রপন্থীদের নির্ভুল নিশানায় মুখ থুবড়ে ফেলে দেওয়ার কাহিনী। সদ্য অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ঘোর মিশুকে আর দিলখোলা মানুষটা এখনও রয়ে গিয়েছেন জল-জঙ্গল, বাঘ-হরিণের ছায়ায়। কখনও ডুয়ার্সে হাতি, কখনও বা সুন্দরবনে ঘুরে ডব্লু ডব্লু এফের হয়ে বাদাবন সংরক্ষণের কাজে ডুবে রয়েছেন বাজ-৮।

south bengal news stories dakshiner karcha karcha of south bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy