ধামাচাপা রাখা গিয়েছিল দশ মাস। কিন্তু, বিরোধীরা খোচাখুঁচি করতেই প্রকাশ্যে এসে গেল বাঁকুড়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের (বিডিসিসিবি) প্রায় ১৫ কোটি টাকা চোট হয়ে যাওয়ার ঘটনা! অভিযোগ, তৃণমূল পরিচালিত পরিচালন কমিটির নির্দেশে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বন্ড কেনার নামে নিয়ম না মেনে সরাসরি ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে বিডিসিসিবি কর্তৃপক্ষ ওই পরিমাণ টাকা জমা দিয়েছিলেন। টাকা আত্মসাৎ করে চম্পট দিয়েছেনই ব্রোকার।
সমবায় ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, গত বছর ওই বন্ড কেনার কথা স্থির করে বিডিসিসিবি-র পরিচালন সমিতি। সেই মোতাবেক এক ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে প্রায় ১৫ কোটি টাকা আরটিজিএস করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। টাকার পরিবর্তে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বন্ডের কিছু নথিপত্র বিডিসিসি কর্তৃপক্ষ হাতে পান। এ বছর জানুয়ারিতেই সেই নথি ভাঙিয়ে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে যেতেই মাথায় বাজ পড়ে সমবায় ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের। তাঁরা জানতে পারেন, ব্রোকারের দেওয়া সব নথিই জাল! এত বড় ঘটনার পরেও বিডিসিসি-র তরফে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় জুলাইয়ে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযুক্ত ব্রোকার দমদমের যোগীপাড়া রোডের বাসিন্দা। পুলিশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত সিআইডি-কে হস্তান্তর করেছে। দেবাঞ্জন রায় নামে ওই ব্রোকার পলাতক। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, পরিচালন সমিতি এবং ব্যাঙ্ক কর্মী ও আধিকারিকদের একাংশ এতে জড়িত। সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘ঘটনাটি জেনেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আমার করা প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতেই এফআইআর হয়েছে। বিভাগীয় তদন্ত চলছে। তদন্তে ব্যাঙ্কের কেউ জড়িত থাকলে তাঁকে ছাড়া হবে না।’’
৯৪ বছরের এই ব্যাঙ্কের লক্ষাধিক গ্রাহক রয়েছেন। সাধারণ মানুষের প্রায় হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে এখানে। জেলার ছোট, বড় প্রায় এক হাজার সমবায় সমিতি আর্থিক ভাবে এই কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল। এ হেন ব্যাঙ্ক এমন কাণ্ড ঘটানোয় অবাক বাঁকুড়া জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভ সার্ভিসেস (এআরসিএস) দেবসুন্দর মাইতি। তিনি জানান, সমবায় ব্যাঙ্ক চাইলে সম্পদ সৃষ্টির জন্য অন্য ব্যাঙ্কের বন্ড কিনতে পারে। তবে, সরাসরি ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার কোনও নিয়ম নীতি নেই। তাঁর কথায়, “আমি বুঝে উঠতে পারছি না, কী ভাবে এই ভুল করলেন ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের পরেই সব পরিষ্কার হবে।’’
দেবসুন্দরবাবু ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের ‘ভুল’ দেখলেও এই ঘটনায় বিডিসিসিবি পরিচালন কমিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন জেলার সিপিএম নেতা তথা এই ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডিরেক্টর প্রতীপ মুখোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার জেলাশাসকের দফতরে পশ্চিমবঙ্গ সমবায় বাঁচাও সংগঠনের তরফে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয় অর্থ তছরুপ নিয়ে।
ওই সংগঠনের জেলা সহ-সভাপতি প্রতীপবাবুর প্রশ্ন, এক জন ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে কীসের ভিত্তিতে ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা দেওয়া হল? দ্বিতীয়ত, জানাজানি হওয়ার পরেও কেন সাত মাস পরে চুপিচুপি অভিযোগ করা হল? তাঁর দাবি, “প্রথম থেকেই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’’
ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন সমবায় মন্ত্রী। ওই সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তথা জেলা তৃণমূল নেতা জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, ব্যাঙ্ককে ঠকানো হয়েছে জানার পরেই ব্রোকারের নামে অভিযোগ হয়েছে। এই ঘটনায় তৃণমূল পরিচালিত বোর্ডের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও তাঁর দাবি। তিনি বলেন, “পরিচালন বোর্ড একটা সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করতে পারে মাত্র। আমরা বন্ড কেনার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলাম। তা বলে ব্রোকারের অ্যাকাউন্টে টাকা দিতে বলিনি! ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের ভুলেই এই কাণ্ড ঘটেছে।’’ বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখ খুলতে চাননি ব্যাঙ্কের সিইও অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়।