Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Crime

ছিল গরু, হয়ে যাচ্ছে বাছুর, কোটি কোটি টাকা ঘুষে অভিযুক্ত বিএসএফ-শুল্ক কর্তারা, রাজ্যে সিবিআই

দুর্নীতির অভিযোগ এনে এ রাজ্যে গরু পাচার নিয়ে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে তারা।

সল্টলেকে বিএসএফ আধিকারিক সতীশ কুমারের বাড়ি সিল করছেন সিবিআই আধিকারিকরা। নিজস্ব চিত্র।

সল্টলেকে বিএসএফ আধিকারিক সতীশ কুমারের বাড়ি সিল করছেন সিবিআই আধিকারিকরা। নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:৪৪
Share: Save:

কলমের সামান্য ‘খোঁচা’। তাতেই গরুকে বাছুর বানিয়ে ফেলা হত বড় সহজে। আর ‘নামসাফাই’য়ের সেই ফাঁক গলেই সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতর (কাস্টমস)-এর ‘বেনামী’ রোজগার হয় কোটি কোটি টাকা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচারের তদন্তে নেমে এমনটাই জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। পাচারের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিএসএফ, কাস্টমস-সহ বিভিন্ন দফতরের একাধিক সরকারি আধিকারিক। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে এ রাজ্যে গরু পাচার নিয়ে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই।

ওই এফআইআরে মূল অভিযুক্তদের অন্যতম সতীশ কুমার। বিএসএফের কমান্ডান্ট পদমর্যাদার আধিকারিক। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫-র ডিসেম্বর থেকে ২০১৭-র এপ্রিল সতীশ কুমার এ রাজ্যে বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট ছিলেন। ওই ১৬ মাসে তাঁর বাহিনী মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্তে বাজেয়াপ্ত করেছিল প্রায় ২০ হাজার গরু। কিন্তু বাজেয়াপ্ত করা সেই গরুকেই বিএসএফের সরকারি নথিতে করা হচ্ছিল বাছুর। এর পর গরুর যা দাম, তার অনেক কম দামে সেই ‘বাছুর’ নিলাম হত স্থানীয় বাজারে। আর নিলামে সেই গরু ফের কম দামে কিনে নিত মুর্শিদাবাদের কুখ্যাত পাচারকারীরা। বিশু শেখ সেই চক্রের মাথা। এখানেই শেষ নয়। নিলামে কিনে নেওয়া ওই গরুই ফের সীমান্ত পেরিয়ে পাচার হয়ে যেত বাংলাদেশে। আর বিএসএফ যে গরুকে ‘বাছুর’ বানিয়ে দিল, তার ‘মূল্য’ হাতেগরমে দিত বিশু শেখের সিন্ডিকেট। বিএসএফের জন্য বরাদ্দ থাকত গরু প্রতি ২ হাজার টাকা। আর ৫০০ টাকা কাস্টমসের জন্য।

মঙ্গলবার সিবিআইয়ের কলকাতার ডিআইজি অখিলেশ কুমার সিংহ একটি এফআইআর (আরসি ১০২০২০এ০০১৯) দায়ের করেন। সিবিআইয়ের করা ওই এফআইআরে অভিযুক্ত করা হয়েছে এই সতীশ কুমারকে। সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার করা ওই এফআইআরে সতীশ একা নন, তাঁর ছেলে, গরু পাচার চক্রের মাথা বিশু শেখ ওরফে মুর্শিদাবাদের ডাকসাইটে ব্যবসায়ী এনামুল হক, তাঁর সঙ্গী আনারুল শেখ ও গোলাম মোস্তাফা-সহ অজ্ঞাত পরিচয়ের একাধিক সরকারি কর্মী এবং অন্যদের নাম রয়েছে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, গরু পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সতীশ নিজে তো লাভবান হয়েছেন, সেই সঙ্গে আর্থিক মুনাফা পেয়েছেন তাঁর ছেলে ভুবন ভাস্করও। সিবিআইয়ের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, সতীশের ছেলে ভুবন ভাস্কর এনামুলের কোম্পানি ‘মেসার্স হক ইন্ডাস্ট্রি’তে চাকরি করেছেন বেশ কিছু দিন। সেখান থেকে তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতনও পেতেন। তদন্তকারীদের দাবি, এটাও ঘুরিয়ে গরু পাচারে সুবিধে করে দেওয়া বাবদ বেআইনি রোজগার।

সিবিআইয়ের অভিযোগ, রাজ্যের গরু পাচার চক্রের পাণ্ডা এনামুল হক। ছবি সংগৃহীত।

গরু পাচারচক্রের হদিশ পেতে বুধবার কলকাতা, সল্টলেক, রাজারহাট, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং ভিন্‌ রাজ্যে সব মিলিয়ে ১৩টি জায়গায় তল্লাশি করে সিবিআই। রাজ্যের বাইরে অমৃতসর, গাজিয়াবাদ এবং রায়পুরে তল্লাশি চালান সিবিআইয়ের আধিকারিকরা। সতীশের সল্টেকের বাড়িতে তল্লাশি চলে। পরে এ দিন সন্ধ্যায় ওই বাড়ি সিল করে দিয়েছে সিবিআই। সতীশ বর্তমানে ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে কর্মরত। সেখানেও তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। সিবিআই হানা দেয় তাঁর গাজিয়াবাদের বাড়িতেও। এ ছাড়া, মুর্শিদাবাদের কুলগাছিয়াতে অভিযুক্ত এনামুলের গ্রামে তাঁর সিন্ডিকেটের দুই শাগরেদ গোলাম মোস্তাফা এবং আনারুল শেখের বাড়িতেও তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা।

৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের সদর দফতর মালদহে হলেও, তার আওতায় থাকা চারটি কোম্পানির পাহারার দায়িত্ব ছিল মুর্শিদাবাদ এবং মালদহের আন্তর্জাতিক নদী সীমান্তের একটা বড় অংশে। সিবিআইয়ের এক আধিকারিক এ দিন বলেন, ‘‘এ রাজ্যে কর্মরত বিএসএফের অন্য এক কমান্ডান্ট জিবু ডি ম্যাথিউকে ২০১৮-য় বিপুল অঙ্কের হিসাব বহির্ভূত টাকাপয়সা-সহ পাকড়াও করা হয়। সেই তদন্তেই উঠে আসে, ওই বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি ঘুষ হিসাবে পেয়েছিলেন গরু পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। জিবুকে জেরা করেই সেই সময় গ্রেফতার করা হয় মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী এনামুল হককে। জানা যায়, এনামুলই গরু পাচার সিন্ডিকেটের মাথা। বিশু শেখ নামে সেই সিন্ডিকেট চালান এনামুল।’’

আরও পড়ুন: ভারতের উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় একাধিক হানা চিনের! দাবি মার্কিন সংস্থার​

এনামুল ওই মামলায় পরে জামিন পান। কিন্তু জিবু এবং তাঁর বয়ানে উঠে আসে সতীশ কুমারের নাম। জানা যায়, ওই গরু পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে জিবুর মতো মোটা টাকা ‘ঘুষ’ নিয়েছেন সতীশও। কী ভাবে বেআইনি লেনদেন হয়েছে, তা জানতে ২০১৮-তেই সতীশের বিরুদ্ধে একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করে সিবিআই। সিবিআই সূত্রে খবর, প্রাথমিক ওই অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএসএফের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে হাজার হাজার গরু পাচার করেছে বিশুর সিন্ডিকেট। মোটা টাকার বিনিময়ে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে গরু পাচার করতে।

শুধু পাচারে সহায়তা নয়, বাজেয়াপ্ত গরুকে খাতায়কলমে বাছুর হিসাবে দেখিয়েও সরকারকে প্রতারণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ সিবিআইয়ের। সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে পাচারকারীদের। সিবিআইয়ের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাঁত করেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু কিছু গবাদি পশু বাজেয়াপ্ত করা হত। সেই সংখ্যাটাই সতীশের এলাকায় ১৬ মাসে প্রায় ২০ হাজার।” তাঁর ব্যাখ্যা, আসলে গরু বাজেয়াপ্ত করে বিএসএফ আধিকারিকরা প্রমাণ করতেন, তাঁরা সীমান্ত প্রহরায় কতটা সতর্ক। কিন্তু সেই ফাঁকেই চলত কোটি কোটি টাকার প্রতারণা। ওই আধিকারিক আরও বলেন, ‘‘একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর দাম যদি নিলামে ৬০ হাজার টাকা হয়, তবে বাছুরের দাম তার প্রায় অর্ধেক। খাতায়কলমে বাজেয়াপ্ত গরুকে বাছুর দেখিয়ে নিলামের সময় দাম কমানোর ব্যবস্থাটা করে দিতেন বিএসএফ আধিকারিকদের একাংশ। কম দামে সেই গরু কিনে ফের পাচার করা হত। আর সেটা করত এনামুলের সিন্ডিকেট।’’

এনামুল হকের লালগোলার বাড়ি, এখানেও তল্লাশি চালান সিবিআই আধিকারিকরা— নিজস্ব চিত্র।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিবিআই জানতে পেরেছে, ওই সময় কালে প্রায় ২০ হাজার গরু ধরা পড়লেও এক বারও কোনও গাড়ি বা কোনও পাচারকারী ধরা পড়েনি। সিবিআই তদন্তকারীদের ইঙ্গিত, গাড়ি বাজেয়াপ্ত করলে সেই গাড়ির মালিক কে, কোথা থেকে গরু বোঝাই করা হয়েছে— এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে। পাচারকারীদের সঙ্গে আঁতাঁতের জন্যই সেই সূত্র কোথাও রেখে দেননি কাস্টমস বা বিএসএফের ওই আধিকারিকদের ওই অংশ। সিবিআইয়ের অভিযোগ, এ ভাবে সরকারের সঙ্গে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা করেছেন কাস্টমস এবং বিএসএফ আধিকারিকদের একাংশ। দুর্নীতি দমন শাখার ৭, ১১ এবং ১২ নম্বর ধারায় ওই আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সিবিআই। যোগ করা হয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ বি ধারাও। আনা হয়েছে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও।

আরও পড়ুন: গরুপাচারে যুক্ত রাঘববোয়ালদের খুঁজতে রাজ্য জুড়ে সিবিআই তল্লাশি​

সিবিআই আধিকারিকদের ইঙ্গিত, বিএসএফ এবং কাস্টমসের পাশাপাশি, এ রাজ্যের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরও নাম উঠে এসেছে প্রাথমিক অনুসন্ধানে। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও বিএসএফ এবং কাস্টমসের আধিকারিকদের মতোই লাভবান হয়েছেন গরু পাচারের সিন্ডিকেট থেকে। তদন্তকারীদের ইঙ্গিত, এই মামলায় ফের এনামুলকে হেফাজতে নেওয়া হতে পারে। সতীশ কুমারকেও প্রয়োজনে গ্রেফতার করে হেফাজতে নিতে পারে সিবিআই, ইঙ্গিত সিবিআই আধিকারিকদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Cattle Smuggling CBI
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE