মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসমের দেখানো পথে পশ্চিমবঙ্গ হাঁটবে কি? জানতে চায় কলকাতা হাইকোর্ট।
ডাইন বা ডাইনি অপবাদ দিয়ে কোনও পুরুষ বা মহিলার উপরে অত্যাচার ঠেকাতে পৃথক আইন করেছে ওই রাজ্যগুলি। একুশ শতকের দেড় দশক পার করেও এই সামাজিক ব্যাধি এ রাজ্যে রয়েছে বহাল তবিয়তে। গত কয়েক মাসে পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় ডাইনি অপবাদ দিয়ে মহিলাদের মারধরের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের এমনই দু’টি ঘটনার জেরে মামলাও দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। একটি ক্ষেত্রে নির্যাতিতা মহিলার জন্য পুলিশি পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ডাইনি অপবাদ দিয়ে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা এড়াতে অন্য কয়েকটি রাজ্যের মতো এ রাজ্য পৃথক কোনও ফৌজদারি আইন তৈরি করবে কি না। এ ব্যাপারে রাজ্যের বক্তব্য কী, তা জানতে চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, এ রাজ্যে ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে মারলে খুনের মামলা দায়ের হয়। কিন্তু কোনও পুরুষ বা মহিলাকে ওই অপবাদ দিলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কম। অনেক সময় অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়।
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি রাজ্য এই নিয়ে পৃথক আইন করেছে। যেমন, বিহার, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড। এ বছরই কড়া আইন হয়েছে অসমে। ডাইনি অপবাদে কারও উপরে অত্যাচার করা হলে ৫-১০ বছরের জেল ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সংস্থান রয়েছে ওই আইনে। ডাইনি অপবাদে হত্যা করা হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বিচার হবে। এমনকী, ডাইনি অপবাদের জেরে কেউ যদি আত্মঘাতী হন, তা হলে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে অভিযপক্তের সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাবাস ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানারও ব্যবস্থা রয়েছে অসম সরকারের আইনে।
মাস কয়েক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে বছর চল্লিশের এক আদিবাসী মহিলাকে নগ্ন করে, পিটিয়ে সপরিবার গ্রামছাড়া করে গ্রামের লোকজন। পুলিশ জানায়, গ্রামের লোকের অভিযোগ, ওই মহিলা ডাইনি। তাঁর অভিশাপেই তাঁর এক আত্মীয় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। গ্রামবাসীদের অত্যাচারের ব্যাপারে থানায় অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার না মেলায় মহিলা কেশিয়াড়িতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে থাকেন। পরে গত ১৬ অক্টোবর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন।
নির্যাতিতার আইনজীবী নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, মহিলাকে গ্রামের লোক ডাইনি অপবাদ দিয়ে নগ্ন করে পেটায়। তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করে। পেটানো হয় তাঁর স্বামী ও ছেলেমেয়েদেরও। কেড়ে নেওয়া হয় মজুত ফসল। নষ্ট করা হয় খেত। নীলাঞ্জনবাবু জানান, মহিলা হাইকোর্টে দায়ের করা মামলায় জেলা পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিয়োগ করেছেন জেনে পুলিশকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। কেশিয়াড়ি থেকে মহিলাকে সপরিবার উদ্ধার করে গ্রামে ঢোকায় পুলিশ। তাঁর বাড়ির সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তাঁকে বাসনপত্রও কিনে দেয় পুলিশ। তা সত্ত্বেও ওই মহিলাকে কার্যত একঘরে করা হয়েছে। তাঁর ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালতে দিন পনেরো আগে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। আইনজীবী নীলাঞ্জনবাবু দাবি করেন, দেশের অনেক রাজ্যেই ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার রুখতে ভারতীয় দণ্ডবিধি ছাড়াও আলাদা আইন রয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে তা নেই। বিচারপতি দত্ত জিপি-কে নির্দেশ দেন, এই ব্যাপারে পৃথক আইন তৈরির বিষয়ে রাজ্যের বক্তব্য কী, তা জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে জানাতে হবে।
হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, এ রাজ্যে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা বা অত্যাচার রোধে পৃথক আইন তৈরি হলে সেখানে নির্যাতিত পুরুষ বা মহিলার জন্য বিশেষ কয়েকটি সুবিধা থাকা দরকার। যেমন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। কারণ, আইন করেও একঘরে করে রাখা বা গ্রামছাড়া করা আটকানো যায় না। তার জন্য শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির উপরে জোর দেওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy