যুবভারতীর ঘটনা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হওয়া একাধিক জনস্বার্থ মামলার শুনানি সোমবার শেষ হল। এই ঘটনায় অভিযুক্ত শতদ্রু দত্তের আইনজীবী দাবি করেছেন, আয়োজক হিসাবে লিয়োনেল মেসিকে যুবভারতীতে নিয়ে আসার যে দায়িত্ব তাঁর মক্কেলের ছিল, তা তিনি পালন করেছেন। অতিরিক্ত লোক কী ভাবে মাঠে প্রবেশ করেছিলেন, তার দায়িত্ব তো শতদ্রুর নয়। রাজ্যের তরফে জানানো হয়েছে, ফুটবলতারকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং অন্য দুই মামলাকারীর তরফে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর দাবি তোলা হয়েছে। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের দাবিও করা হয়েছে। রাজ্যের গঠন করা সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল)-এর তদন্তে তাঁদের ভরসা নেই বলে জানানো হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুজয় পাল এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার রায় ঘোষণা স্থগিত রাখেন।
যুবভারতীকাণ্ডে হাই কোর্টে মোট তিনটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। তার মধ্যে একটিতে ধৃত শতদ্রুকে পক্ষ করা হয়। সেই তিন মামলার শুনানি ছিল সোমবার।
শতদ্রুর আইনজীবীর সওয়াল
শতদ্রুর আইনজীবী বিশ্বজিৎ মান্না সোমবার আদালতে জানান, তাঁর মক্কেলকে ওকালতনামায় সই করাতে পারেননি। কারণ, থানা অনুমতি দেয়নি। এর পরেই তিনি সওয়াল করে বলেন, ‘‘তদন্ত নিয়ে কিছু বলব না। যে সংস্থাই তদন্ত করুক, আমাদের আপত্তি নেই।’’ তার পরেই তিনি জানান, মেসির সফর শুধু কলকাতায় হয়নি, হায়দরাবাদ, মুম্বই, দিল্লিতেও হয়েছে। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ ওঠেনি। শুধু কলকাতায় অভিযোগ ছিল। আইনজীবীর মাধ্যমে শতদ্রু বলেন, ‘‘আমি অভিযুক্ত, তাই তদন্ত নিয়ে বলব না। হায়াত রিজেন্সিতে কী হয়েছে, সেটা অন্য বিষয়।’’
শতদ্রুর আইনজীবী সওয়াল করে জানান, নির্দিষ্ট তারিখে মেসির আসার কথা ছিল। দর্শক তাঁকে দেখতে টিকিট কেটেছিলেন। তাঁরা আয়োজক। মেসি এসেছেন। মাঠে নেমেছেন। আইনজীবীর মাধ্যমে শতদ্রু বলেন, ‘‘আমার ওঁকে কলকাতায় নিয়ে আসার কথা ছিল। আমি এনেছি। যুবভারতীতে তিনি নেমেছেন। আয়োজক হিসাবে কথা রেখেছি। এখন আমায় বলা হচ্ছে, টিকিটের টাকা ফেরত দিতে হবে!’’ মেসির কলকাতা সফরে কত পাস তাঁদের তরফে দেওয়া হয়েছিল, তা-ও আদালতে জানিয়েছেন শতদ্রুর আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘‘৪০০ পাস দিয়েছি, যাঁরা মাঠে থাকবেন। তার মধ্যে ছিলেন পারফর্মার, খেলোয়াড়, নিরপত্তারক্ষী, নৃত্যশিল্পী। পাস ছাড়া কাউকে মাঠে প্রবেশের যে অনুমতি দেওয়া হবে না, সেটা পুলিশের ঠিক করার কথা। আমি বলিনি যে, ভিআইপিরাই শুধু মাঠে প্রবেশ করবেন। কারা প্রবেশ করেছেন, তা পুলিশ ঠিক করেছে।’’
রাজ্যের তরফে জানানো হয়েছিল, কাউকে কাউকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ‘হাই প্রায়োরিটি’ পাস দেওয়া হয়েছিল। শতদ্রুর আইনজীবী এই অভিযোগ মানেননি। তাঁর সওয়াল, প্রবেশপথে পুলিশ ছিল। তার পরেও দেখা গিয়েছে, অনেক বেশি জন প্রবেশ করেছেন। তা ছাড়া মেসির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল এনএসজি কমান্ডো। আইনজীবীর সওয়াল, ‘‘অতিরিক্ত লোক ঢুকল, সেই দায়িত্ব কী আমার? ’’ যুবভারতীতে মেসিকে অনেকে জোর করে স্পর্শ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে শতদ্রুর আইনজীবীর সওয়াল, মেসির রক্ষীরা স্থির করবেন, কে স্পর্শ করবেন, কে নয়। তা ছাড়া অনেক পুলিশকর্মীকেও মেসির সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা গিয়েছে। জলের বোতল নিয়ে মাঠে পুলিশই ঢুকতে দিয়েছে। দর্শকদের অভিযোগ ছিল, হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যুবভারতীতে গিয়ে মেসিকে ভাল ভাবে দেখতে পাননি তাঁরা। এই প্রসঙ্গে শতদ্রুর আইনজীবীর সওয়াল, অরিজিৎ সিংহ, শ্রেয়া ঘোষালের অনুষ্ঠানের টিকিট ১৫ হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। টিকিটের দাম নির্ভর করে অনুষ্ঠানের উপর।
আরও পড়ুন:
শুভেন্দুর আইনজীবীর সওয়াল
শুভেন্দুর আইনজীবী বিল্বদল ভট্টাচার্য সওয়াল করে বলেন, ‘‘১৩ ডিসেম্বর মেসির কলকাতায় সফরের জন্য অগস্ট থেকে প্রচার হয়। শতদ্রু বলেন, মেসি আসবেন, বল নিয়ে খেলবেন। রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু মেসিকে দিয়ে ৭০ ফুট দীর্ঘ মূর্তি উন্মোচন করান। সল্টলেকের এক হোটেলে টাকা নিয়ে মেসির সঙ্গে ছবি তোলার ব্যবস্থা করা হয়। সেই কারণে মেসি ৪০ মিনিট দেরিতে যুবভারতীতে যান। তার পর তাঁকে বার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতেই ক্ষুব্ধ হন দর্শক। অবাঞ্জিত ঘটনা হয়। উদ্বেগজনক হল, আট জন দর্শককে গ্রেফতার করা হয়।’’ এর পরেই শুভেন্দুর আইনজীবী আরও বলেন, ‘‘এই ঘটনায় প্রভাবশালীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। আর্থিক দুর্নীতি রয়েছে। আগাম ৬৫ কোটি টাকা দেওয়া হয় মেসিকে। এই টাকা কোথা থেকে দেওয়া হয়? সল্টলেকের হোটেলে সুজিত ব্যবস্থাপনা করেন। যুবভারতীর ভিতরে ব্যবস্থাপনায় ছিলেন অরূপ বিশ্বাস।’’ শুভেন্দুর দাবি, হাই কোর্টের বিচারপতির নজরদারিতে নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানো হোক।
দুই মামলাকারীর আইনজীবীর সওয়াল
ময়ূখ বিশ্বাসের আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় সওয়াল করে জানান, যুবভারতীকাণ্ডের অডিট করানো হোক ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)-কে দিয়ে। সবের নেপথ্যে রয়েছে রাজ্য সরকার। নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। ইডিকে দিয়ে তদন্ত করা হোক। সিবিআই তদন্তেরও দাবি করেছেন তিনি।
আয়ুষ মজুমদারের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সওয়াল করে এই ঘটনায় সিবিআই, ইডি তদন্ত চেয়েছেন। তাঁর সওয়াল, ‘‘সাধারণ মানুষের টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তৈরি কমিটি ডিজিকে শো কজ় করেছে, যা লোকদেখানো। পুলিশ স্বতপ্রণোদিত এফআইআর করে দর্শকদের উপর দায় ঠেলেছে। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে দেখানো হয়েছে। রাজ্যের সিনিয়র অফিসারদের দিয়ে সিট হয়েছে। এঁরা কি নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবেন, যেখানে মন্ত্রীরা যুক্ত?’’
রাজ্যের আইনজীবীর সওয়াল
রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সওয়াল, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সংবেদনশীলতার জন্যই ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। শাহরুখ খান, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যে উপস্থিত থাকবেন, লিখিত ভাবে পুলিশকে তা জানানো হয়নি। যুবভারতীর ভিতরে জলের বোতল নিয়ে প্রবেশের অনুমতি নেই।’’ কল্যাণের আরও সওয়াল, মেসিকে জ়েড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে। নিরাপত্তাকর্মী কত জন থকবেন, তা রাজ্যকে জানানো হয়নি। ৫০০ জনকে পাস দেন শতদ্রু। তাঁদের মধ্যে ২৭ জন মেসির সামনে থাকার কথা ছিল। যুবভারতী, বিমানবন্দর মিলিয়ে। বাকি ৩৭৩ ডিউটি পাস। আইবি ওয়েস্টবেঙ্গল ১২ জনকে পাস দেয়, যাঁদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। পুলিশকে ২৫টি পাস দেওয়া হয়। মোট ৮২টি পাস দেওয়া হয়, যাতে ছিল মেসির কাছে থাকার ‘ক্লোজ় প্রক্সিমিটি’ অনুমতি। রাজ্যকে তদন্ত করতে সময় দেওয়া হোক। কল্যাণের সওয়াল, ইতিমধ্যে বিধাননগর পুলিশের ডিসি অনীশ সরকারকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে। কয়েক জন পুলিশকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কল্যাণের সওয়াল, এই মামলা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের খবরের উপর ভিত্তি করে। সব টিকিট আয়োজকেরা বিক্রি করেন, কত বাজেট হবে তাঁরা জানেন। মেসির মূর্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুজিত তৈরি করিয়েছেন। বিচারপতি পার্থ বলেন, ‘‘মেসির মূর্তি কি ব্যক্তিগত সম্পত্তি?’’ কল্যাণ বলেন, ‘‘জেনে এসে বলব। মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছেন এর থেকে বড় কী হতে পারে। আমরা টাকা ফেরানোর কেউ নই।’’ রাজ্য বলেছে, ২২ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে শতদ্রুর পাঁচটি অ্যাকাউন্ট থেকে। কল্যাণের সওয়াল, যুবভারতীর মাঠে ক্রীড়ামন্ত্রী ছাড়া কোনও রাজনীতিককে দেখা যায়নি।
প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, ‘‘বাইরে যা হয়েছে সে বিষয়ে রাজ্যের কী মত?’’
যুবভারতীকাণ্ডের তদন্তের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কমিটি গঠন করে। তাকে চ্যালেঞ্জ করে গত ১৫ ডিসেম্বর জোড়া জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাই কোর্টে। কমিটির ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। হাই কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুজয় পাল এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি পৃথক ভাবে আকর্ষণ করেন আইনজীবী সব্যসাচী। উভয়েরই বক্তব্য, রাজ্যের গঠিত কমিটির ক্ষমতা নেই। তারা সঠিক তদন্ত করতে পারবে না। তাই পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করুক আদালত। শুভেন্দু আদালতের নজরদারিতে তদন্ত চান। দু’টি মামলার অনুমতি দেয় ডিভিশন বেঞ্চ।
পরে আরও একটি মামলা হয় হাই কোর্টে। মামলাকারী মৈনাক ঘোষাল আদালতের নজরদারিতে তদন্তের আর্জি জানান। সেই সঙ্গে দর্শকদের টিকিটের অর্থ ফেরত দেওয়া উচিত বলেও জানান তিনি। আর্থিক তছরুপের কথা উল্লেখ করে ইডি ও সিবিআইয়ের তদন্তের আবেদন জানান ওই মামলাকারী। তাঁর দাবি, স্টেডিয়ামের ক্ষয়ক্ষতির অর্থও প্রদান করতে হবে আয়োজক সংস্থাকে।
গত ১৩ ডিসেম্বর যুবভারতীতে এসেছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা ফুটবলার লিয়োনেল মেসি। তাঁকে দেখতে হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সল্টলেক স্টেডিয়ামে যান তাঁর ভক্তেরা। কিন্তু মেসি মাত্র ১৬ মিনিট মাঠে ছিলেন। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার কারণে নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। অভিযোগ, এক মুহূর্তের জন্যেও মেসিকে দেখা যায়নি গ্যালারি থেকে। এর পরেই ক্রোধে উন্মত্ত জনতা তাণ্ডব চালায় স্টেডিয়াম জুড়ে। মাঠে ছোড়া হয় বোতল, ভাঙা চেয়ার। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। পরে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন মেসি এবং দর্শকদের কাছে। তদন্তের জন্য কমিটিও গড়ে দেন। কমিটির মাথায় ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীমকুমার রায়। এ ছাড়াও, কমিটিতে ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তীরা। সেই কমিটির সুপারিশে তদন্ত শুরু করেছে সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল)।