পুলিশি তদন্তে পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকতে পারে। তার জন্য ন্যায়বিচার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। একটি খুনের মামলায় এমনটাই পর্যবেক্ষণ কলকাতা হাই কোর্টের। ২০১২ সালে এক রিকশা চালককে খুনের অপরাধে এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। সেই রায়ই বহাল রাখল। তাদের পর্যবেক্ষণ, প্রকৃত প্রমাণ থাকলে এবং তা বিশ্বাসযোগ্য হলে, তার উপরে ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। তদন্তে ত্রুটি থাকলেও কিছু হেরফের হয় না।
হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সত্য জানতে এবং অভিযুক্ত আদতে দোষী কি না বুঝতে বিচার চলে। আইনের শাসন বলবতের জন্য স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। পাশাপাশি, এটাও ঠিক নয় যে, তদন্তের ত্রুটির কারণে কোনও অভিযুক্তকে খালাস করে দেওয়া হবে, যেখানে তাঁর দোষের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।’’
২০১২ সালের ৯ নভেম্বর খুন হয়েছিলেন রিকশাচালক মদন রায়। ২০১৪ সালের ৯ জুন সোনারপুর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি থানায় ফোন করে জানান, বাবলু যাদব নামে এক জন স্থানীয় ক্লাবে প্রবেশ করে প্রকাশ্যে দাবি করেন, রিকশাচালক মদনকে খুন করেছেন জ্ঞানসাগর শর্মা। তার পরেই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। বাবলু এই খুনের অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। জ্ঞানসাগরকেই পরে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত।
শর্মার গ্রিলের কারখানার কাছে মাটি খুঁড়ে এর পরে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করে পুলিশ। পাশাপাশি একটি কালো ট্রাউজ়ার্স, চাবিও উদ্ধার করা হয়। পুলিশি তদন্তে জানা যায়, ওই কালো ট্রাউজ়ার্স মদনের। তবে হাড়গোড় তাঁর কি না, ফরেন্সিক তদন্তকারীরা তা নিশ্চিত করতে পারেননি। তাঁরা জানান, ওই হাড়গোড় এক জন পুরুষের এবং তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
ওই খুনের এক মাত্র সাক্ষী ছিলেন মদনের পুত্র অভিজিৎ রায়। তিনি জানান, ২০১২ সালের ৯ নভেম্বর রাতে শর্মা এবং যাদব তাঁদের বাড়িতে গিয়ে মদনকে গুলি করে খুন করেন। সে বিষয়ে তিনি যাতে কাউকে কিছু না বলেন, তা নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন শর্মার পুত্র রঞ্জিত। অভিজিৎ আরও জানান, মদনের দেহ কেটে পুঁতে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁকে জানিয়েছিলেন রঞ্জিত। ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিজিৎ এ-ও জানান যে, শর্মার সঙ্গে তাঁর মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি প্রসেনজিৎ বিশ্বাস দোষী সাব্যস্ত করেন শর্মাকে।
শর্মার আইনজীবী কোর্টে সওয়াল করে জানান, অভিজিৎ প্রথমে জানিয়েছিলেন টাকার জন্য তাঁর বাবাকে খুন করা হয়েছে। শর্মার সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্ক ছিল বলে জানাননি। তা ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে যে ছুরি মিলেছিল, তার ফরেন্সিক পরীক্ষা করানো হয়নি। এই প্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, কোনও সন্তানের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে তাঁর মায়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা জানানো সহজ নয়। মায়ের কথা ভেবে, পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে পুত্রের বিষয়টি চেপে যাওয়াই স্বাভাবিক। পুলিশি তদন্তের ত্রুটির বিষয়টিও উড়িয়ে দেয় বেঞ্চ। তার পরেই শর্মার যাবজ্জীবন বহাল রাখে তারা।