সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে এ বার খোদ নবান্নের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাল সিবিআই। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে চেয়েছে, ২০১১-১২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তারা কোনও অভিযোগ পেয়েছিল কি না। অভিযোগ পেয়ে থাকলে সে ব্যাপারে কোনও তদন্ত করা হয়েছিল কি না। এবং তদন্ত হয়ে থাকলে তার রিপোর্ট-সহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়েছে সিবিআই।
মাসখানেক আগে ওই চিঠি নবান্নে পৌঁছলেও এখনও তার জবাব দেয়নি রাজ্য সরকার। সিবিআই-ও জানিয়েছে, ১৯ সেপ্টেম্বর লেখা ওই চিঠির (নম্বর: ৩৩৫/৩/৪/এস/২০১৪)জবাব পায়নি তারা। কিন্তু কেন এখনও সিবিআইয়ের চিঠির জবাব দেওয়া গেল না, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। এক জন শুধু বলেছেন, “উঁচুতলার সবুজ সঙ্কেত পেলেই সিবিআইয়ের চিঠির জবাব পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” কিন্তু কবে, তার কোনও সদুত্তর মেলেনি।
ক’দিন আগেই সারদা কেলেঙ্কারির প্রথম চার্জশিট পেশ করেছে সিবিআই। তাতে তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষের নাম থাকলেও আর কোনও বড় মাপের রাজনৈতিক নেতার নাম নেই। সিবিআইয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “তদন্ত যত গড়িয়েছে, বোঝা গিয়েছে, সারদা কেলেঙ্কারি কেবল লগ্নিকারীদের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা নয়, নিছক আর্থিক নয়ছয়ও নয়। এর পিছনে বৃহত্ ষড়যন্ত্র রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই ষড়যন্ত্রের শিকড়ে পৌঁছতে চাইছি আমরা।”
কী ভাবে? সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, তদন্তে নেমে তারা এ পর্যন্ত যে ক’জনকে জেরা করা হয়েছে, তাঁদের অনেককেই বিভিন্ন সময়ে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে দেখা গিয়েছে। সেই জেরারই সূত্র ধরে আরও এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, যাঁদের খুব শীঘ্রই সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে পাঠানো হবে। তদন্তকারী অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্যের তৈরি সিটের কাছ থেকে যত নথি পাওয়া গিয়েছে, সে সব খতিয়ে দেখে জানা যাচ্ছে, ২০০৭ সালে সারদা লগ্নির কারবার শুরু করলেও ২০১১-এর পর থেকেই তা ফুলেফেঁপে ওঠে। ওই সময় এক দিকে যেমন শ’য়ে শ’য়ে এজেন্ট নিয়োগ হয়েছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমানতকারীর সংখ্যাও। সিবিআইয়ের যুক্তি, সারদার ওই বাড়বাড়ন্তে রাজ্যের কোনও প্রশ্রয় ছিল কি না, একই সঙ্গে ওই সংস্থা কোনও ভাবে সরকারের উপরে প্রভাব ফেলেছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতেই নবান্নে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
কেন সিবিআইয়ের এমন ধারণা হল? তদন্তকারী অফিসারদের একাংশ জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই সারদাকর্তা সুদীপ্ত সেনকে সিমেন্ট কারখানা বিক্রি নিয়ে রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে একাধিক বার জেরা করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শ্যামাবাবুকে জেরা করেছে সিবিআই-ও। সারদা-সূত্রেই রাজ্যের আর এক মন্ত্রী মদন মিত্রের প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক ও বর্তমান এক ঘনিষ্ঠকে ডেকে পাঠিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ জেরা করেছে ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। সিবিআই সূত্র বলছে, এর বাইরেও সারদার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলতেন এমন কিছু লোকজনের নাম হাতে এসেছে, যাঁরা শাসক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত। ওই সম্পর্কগুলোই সারদাকর্তাকে সরকারের কাছাকাছি এনেছিল কি না, তা পরখ করতে চাইছে সিবিআই।
সিবিআইয়ের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও এ রাজ্যের লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে নবান্নে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল। প্রশাসন সূত্রের খবর, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগ এ পর্যন্ত রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে ছ-ছ’টি চিঠি দিয়েছে। সব চিঠিরই বয়ান কার্যত একই রকম। লগ্নি সংস্থার বেআইনি আর্থিক লেনদেন ঠেকাতে রাজ্য কী পদক্ষেপ করেছে, সেই কথাই জানতে চেয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নবান্নের এক কর্তা বলেন, “ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা একাধিক লগ্নিকারী সংস্থা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সেবি বিভিন্ন সময়ে রাজ্যকে যে চিঠি দিয়েছিল এবং তার ভিত্তিতে প্রশাসন কী পদক্ষেপ করেছিল, এখন আতসকাঁচে সে সব যাচাই করতে চাইছে সিবিআই।”
দিল্লি থেকে আসা সে সব চিঠির একটিরও জবাব দেয়নি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর। ওই সব চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হতো অর্থ দফতরে। কেন? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “আর্থিক শৃঙ্খলা দেখার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। অর্থ দফতরই এ বিষয়ে পারদর্শী। তারাই নিয়মিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি-র সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ফলে লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম অর্থ দফতরেরই জানার কথা।” নবান্ন সূত্র অবশ্য বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠির জবাব না দেওয়া হলেও সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার কয়েক মাস পরে আলাদা করে চিঠি পাঠানো হয় দিল্লিতে। তাতে সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরাতে সরকার কী কী করেছে, তার খুঁটিনাটি জানানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। কিন্তু রাজ্যের ওই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি দিল্লি। তাদের বক্তব্য, কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে সরকার ওই পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু কেলেঙ্কারি ঠেকাতে আগাম কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, চিঠিতে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না।