Advertisement
১১ মে ২০২৪
Panchayet election 2023

ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে ‘দ্বিমুখ’ই সেনাপতি পদ্মের, অভিভাবক তৃতীয় মুখ! নীল নকশা বানাচ্ছে দিল্লি

আগামী বছর পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার পরের বছর লোকসভা নির্বাচন। দুই ভোটকে সামনে রেখে সংগঠন সাজানোই লক্ষ্য বিজেপির। লোকসভায় সাফল্য পেতে পঞ্চায়েতে ‘ভিত’ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে পদ্ম শিবির।

পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি শুরু রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের।

পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি শুরু রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২২ ১৫:৩৭
Share: Save:

বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। শাসক তৃণমূল ইতিমধ্যেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। নভেম্বরের গোড়া থেকেই পথে নামছে তৃণমূল। ১ নভেম্বর থেকে দলের মহিলা সংগঠনের বুথ কমিটির সদস্যদের ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে কর্মসূচির পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে— ‘চলো গ্রামে যাই’।

নভেম্বরেই ‘গ্রামে চলো’ বিপ্লবের সূচনা করতে চাইছে বিরোধী বিজেপিও। তবে শাসকের তুলনায় এখনও অনেকটাই অগোছালো গেরুয়া শিবির। তাই নভেম্বরে কোনও কর্মসূচি না নিয়ে সাংগঠনিক শক্তি যাচাইয়ের কাজ শুরু করতে চাইছে তারা। পুজোর ঠিক পরেই ১৬ অক্টোবর কলকাতায় এসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি বৈঠক সেরে গিয়েছেন এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনশল। সেই বৈঠকে মূলত দক্ষিণবঙ্গ নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। এ বার নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁর তিন দিনের সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। তা মূলত উত্তরবঙ্গে হবে বলেই বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘প্রধান মুখ’ হবেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাকিরা প্রচারে অংশ নেবেন। কিন্তু মূল সেনাপতি হিসাবে দু’টি মুখকেই তুলে ধরা হবে। পিছন থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে থাকবেন সুনীল এবং রাজ্যের পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে। এঁরা দু’জন মূলত পরিকল্পনা তৈরির কাজ করবেন।

মূল সেনাপতি সুকান্ত, শুভেন্দু। তবে দিলীপের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে চায় গেরুয়া শিবির।

মূল সেনাপতি সুকান্ত, শুভেন্দু। তবে দিলীপের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে চায় গেরুয়া শিবির। ফাইল চিত্র।

দিলীপ ঘোষকে কি পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে না? বিজেপি শিবিরের একাংশ মনে করে, সেটা ঠিক হবে না। কারণ, এ রাজ্যে বাকিদের তুলনায় দিলীপের অভিজ্ঞতা বেশি। সে সব শোনার পরেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইছেন, দিলীপ ‘অভিভাবক’ হিসাবেই থাকুন। প্রচারে তাঁকে বেশি করে ব্যবহারও করা হতে পারে। কিন্তু প্রার্থী বাছাই থেকে পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্বে থাকবে সুকান্ত-শুভেন্দু জুটি।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছেন রাজ্য নেতারা। তবে প্রকাশ্যে কেউই এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। অনেকেই মনে করছেন, দিলীপকে বাদ দিয়ে লড়াই করা কঠিন হবে। এখনও অনেক কর্মী-সমর্থক দিলীপকে ‘নেতা’ হিসাবে দেখতে চান। পুরনো কর্মীদের একটা অংশ বসেও যেতে পারেন। ফলে এই বিষয়টি নিয়েও কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। কারণ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলে রোষের মুখে পড়তে চান না কেউ। তবে সুকান্ত আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, ‘‘বিজেপিতে মুখ একটাই। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁকে সামনে রেখেই দেশের সর্বত্র সব নির্বাচনে লড়াই হয়। বিজেপির রথ তাতেই এগিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, বিজেপি কর্মীনির্ভর দল, নেতানির্ভর নয়। কর্মীরাই বিজেপির শক্তি। লড়বেন তো তাঁরাই। ‘মুখ’ বলে কিছু হয় না। দল দায়িত্ব দিয়েছে বলেই পদ। এমনিতে সবাই কর্মী। আর দিলীপ’দার অভিজ্ঞতা তো কাজে লাগাতেই হবে। সেটা আমাদের সম্পদ।’’

তবে শুধুই রাজ্য নেতৃত্বের উপর ভরসা রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মাঠে নামতে চাইছেন না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। সুনীল কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার পরের দিনই কেন্দ্রীয় ভাবে রাজ্যের ‘কোর কমিটি’ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটিতে মিঠুন চক্রবর্তী-সহ অনেক নতুন মুখ দেখা গিয়েছে। রাজ্য বিজেপির কোর কমিটি গঠনে এমন কেন্দ্রীয় উদ্যোগ ইদানীং কালে দেখা যায়নি। তাতেই মোটামুটি স্পষ্ট যে, বাংলার গ্রামের ভোটেও পরিকল্পনার ভার দিল্লিই নিচ্ছে। রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা প্রাথমিক নকশাও তৈরি করে ফেলেছেন। তাতে ঠিক হয়েছে, ২০১৮ সালের মডেলেই ভোট লড়তে হবে ২০২৩-এ। কারণ, কেন্দ্রীয় বিজেপি মনে করে ২০১৮-র লড়াইয়েরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। তাই ২০২৩-এর লড়াই দিয়ে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ‘ভিত’ তৈরি করতে চান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

দিল্লিই যে রাজ্যের ভোট নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা নিতে চলেছে, সেটা সরাসরি না মানলেও সুকান্ত বলেন, ‘‘এটাই বিজেপির সংস্কৃতি। প্রকৃত সর্বভারতীয় দল এমনই হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং রাজ্য নেতৃত্ব একসঙ্গে কাজ করেন। কারণ, গোটা দেশেই একই নীতি নিয়ে চলে বিজেপি। অন্য দলের সেই শক্তিও নেই, সেই নীতিও নেই।’’ একইসঙ্গে বাংলার সংগঠন দুর্বল বলেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ, তা মানতে নারাজ সুকান্ত। তিনি বলেন, ‘‘গুজরাতে তো আমাদের অনেক শক্তি। সেখানেও কিন্তু (বিধানসভা) নির্বাচন পরিচালনায় বিভিন্ন রাজ্য থেকে নেতাদের নেওয়া হয়েছে। বাংলারও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।’’

নভেম্বরের গোড়াতেই রাজ্য আসার কথা সুনীল বনসলের।

নভেম্বরের গোড়াতেই রাজ্য আসার কথা সুনীল বনসলের। ফাইল চিত্র।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের সর্বত্র প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল বিজেপি। গেরুয়া শিবির দাবি করেছিল, শেষ পর্যন্ত ৭৭ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬২ হাজারে প্রার্থী দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা-ও সম্ভব হয়নি। সে বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ উঠেছিল। বিজেপি দাবি করেছিল, গ্রাম পঞ্চায়েতে বহু প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন বা মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলেন। পঞ্চায়েত সমিতিতে অবশ্য তুলনায় বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিল বিজেপি। বীরভূম ছাড়া অন্যত্র জেলা পরিষদেও সব আসনে প্রার্থী ছিল বিজেপির। বীরভূম জেলা পরিষদে একটি আসনেই পদ্মের প্রার্থী ছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে বেকায়দায়-পড়া বিজেপির অভিযোগ ছিল, তৃণমূল ব্যাপক হারে ভোট ‘লুট’ করেছে। দিলীপের নেতৃত্বে এই অভিযোগই ছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রচারের বড় অস্ত্র। রাজ্যের পাশাপাশি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এটাও মনে করেন যে, নরেন্দ্র মোদী হাওয়া থাকলেও সঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারাটাও সাধারণ মানুষের মধ্যে শাসকের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার শক্তি তৈরি করে দিয়েছিল। যার সুবিধা মিলেছিল এক বছর পরের লোকসভা নির্বাচনে।

বিজেপি মনে করছে, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটেও তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি কাজে লাগাতে হলে যত বেশি সম্ভব আসনে প্রার্থী দিতে হবে। শাসকের বিরুদ্ধে মনোনয়নে বাধা বা ভোট লুটের অভিযোগ তুলতে গেলেও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা দরকার। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইছেন, সামান্য শক্তি রয়েছে, এমন জায়গাতেও যাতে প্রার্থী দেওয়া যায়। রাজ্যকে বলা হয়েছে, ৯০ শতাংশ আসনে যাতে প্রার্থী দেওয়া যায়, সে দিকে নজর দিতে হবে। যেখানে যেখানে প্রার্থী দেওয়া কঠিন হবে, সেখানে সুকান্ত, শুভেন্দুকে যেতে হবে। সেই কাজে প্রয়োজনে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপকেও সঙ্গে নিতে হবে।

১ নভেম্বর থেকে তৃণমূল যে ‘চলো গ্রামে যাই’ কর্মসূচি নিয়েছে, সেখানে দলের মহিলা নেত্রীরা বাড়ির হেঁশেলে পৌঁছে গিয়ে সেই বাড়ির সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নেবেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেলে তাঁদের ‘দুয়ারে সরকার’-এর শিবিরে গিয়ে সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেবেন। বিজেপিও কি এমন কোনও পরিকল্পনা নেবে? সুকান্ত বলেন, ‘‘সব ধীরে ধীরে জানানো হবে। মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়া তো আমাদের পুরনো কর্মসূচি। সেটা আমরা সারা বছরই করি। তৃণমূল তো সারা বছর তোলা তুলতে যায়! আর ভোটের আগে খোঁজ নেওয়ার নাটক করে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Panchayet election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE