Advertisement
E-Paper

মিছিল বেরোতেই মার পুলিশ-তৃণমূলের

মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ, ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দিতেই হবে। তার অন্যথা হলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। সেই নির্দেশ শিরোধার্য করেই বুধবার সকালে ধর্মঘট উপেক্ষা করে কাজে যোগ দিতে আসার খেসারত নিজের মাথা ফাটিয়ে দিলেন দীপক মুখোপাধ্যায়!

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৩
লাঠি হাতে বন্‌ধের বিরুদ্ধে। ক) মুর্শিদাবাদের তৃণমূল জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের ছেলে রাজীব হোসেন  খ) নিজামুদ্দিন আজাদ  গ) শাজাহান শেখ।  বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

লাঠি হাতে বন্‌ধের বিরুদ্ধে। ক) মুর্শিদাবাদের তৃণমূল জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের ছেলে রাজীব হোসেন খ) নিজামুদ্দিন আজাদ গ) শাজাহান শেখ। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ, ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দিতেই হবে। তার অন্যথা হলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। সেই নির্দেশ শিরোধার্য করেই বুধবার সকালে ধর্মঘট উপেক্ষা করে কাজে যোগ দিতে আসার খেসারত নিজের মাথা ফাটিয়ে দিলেন দীপক মুখোপাধ্যায়!

বহরমপুরের বাড়ি থেকে সকাল দশটা নাগাদ অফিসে যাচ্ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন ভবনের কর্মী দীপকবাবু। তখন বহরমপুর টেক্সটাইল কলেজের মোড়ে ধর্মঘট ঘিরে সংঘর্ষ চলছে। ইট ও বাঁশের আঘাতে তাঁর মাথা ফেটে যায়। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দীপকবাবুর কথায়, ‘‘দিব্যি হেঁটে অফিসে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে কী যে হয়ে গেল!’’

দীপকবাবু আক্রান্ত সরকারের নির্দেশ মানতে গিয়ে। তাঁর জেলারই হরিহরপাড়ায় আবার সিপিএম বিধায়কের রক্ত ঝরেছে ধর্মঘটের সমর্থনে পথে নামায়। ধর্মঘট রুখতে নামা শাসক দল এবং ধর্মঘটী বাম নেতা-কর্মীরা— যুযুধান দু’পক্ষের গোলমালে এ দিন অশান্তির ছবি দেখা গেল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। বহরমপুর থেকে মহম্মদবাজার, আউশগ্রাম থেকে হরিহরপাড়া— সংঘর্ষে তপ্ত হয়েছে বহু এলাকা। বহিরাগতদের এনে, পুলিশকে পাশে নিয়ে ইট-পাটকেল, লাঠিসোঁটা, রড নিয়ে বাম নেতা-কর্মীদের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। পুলিশের সামনেই আক্রান্ত হয়েছেন সিপিএমের দুই বিধায়ক এবং এক প্রাক্তন সাংসদ। আহত আরও অনেকে। ভাঙচুর চলেছে একের পর এক সিপিএমের পার্টি অফিসে।

ঘটনা হল, এ দিন রাজ্য জুড়েই ধর্মঘট ব্যর্থ করতে রীতিমতো রাস্তা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তৃণমূলের কর্মীরা। সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী তাই এ দিন মন্তব্য করেছেন, ‘‘সরকারের এক বর্ষীয়ান মন্ত্রী আগের দিন বলেছিলেন, তাঁদের লোকজন কেউ ঝান্ডা নিয়ে থাকবে না। তখনই বুঝেছিলাম, ডান্ডা নিয়ে থাকবে! বাস্তবে সেটাই ঘটেছে।’’ দিনভর এত কিছুর পরেও বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করলেন, ‘সিপিএম-ই গুন্ডামি’ করেছে। তাঁর দলের কর্মীরা এ দিন সংযতই ছিলেন! নবান্নে তিনি বলেন, ‘‘আমি তো টিভিতে দেখলাম সিপিএম-ই হাতে ঝান্ডা দিয়ে আমাদের ছেলেদের মারছে! ছবি-ই তো সব কথা বলবে।’’

এ দিনের সব চেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে বহরমপুরে। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ শহরের টেক্সটাইল মোড়ে সিপিএমের জেলা কার্যালয় থেকে মিছিল বার হতে-না-হতেই পুলিশ আটকে দেয়। সেই সময় বাদানুবাদের পর শুরু হয় মার। প্রথমে পুলিশের লাঠিতে লুটিয়ে পড়েন মিছিলের নেতৃত্বে থাকা প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান। তাঁকে মাড়িয়েই চলে যায় কিছু পুলিশকর্মী। লাঠিতে মাথা ফাটে দলের দলের জোনাল কমিটির সম্পাদক গণেশ সরকারের। অভিযোগ, এর পরেই আক্রমণ করে তৃণমূলের বাহিনী। পুলিশের সামনেই নাগাড়ে ইটবৃষ্টি। রাস্তায় ফেলে সিপিএম সমর্থকদের লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই জখম হন ২৫ জন সিপিএম কর্মী-সমর্থক। ঘটনাস্থলের কাছেই দাঁড়িয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেনের গাড়ি। অভিযোগ, সিপিএম কর্মীরা সেই গাড়িতে ভাঙচুর চালান।

তাতে গোলমাল আরও বাড়ে। সিপিএমের দলীয় অফিসে ঢুকে মোটরবাইক, সাইকেল ভাঙচুর করে আগুনও লাগিয়ে দেয় তৃণমূল দুষ্কৃতীরা বলে অভিযোগ। হরিহরপাড়ায় দলীয় মিছিল থেকে ফেরার পথে আক্রান্ত হন সিপিএম বিধায়ক ইনসার আলি। তৃণমূলের মারে তাঁর মাথা ও নাক ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। তিনি ও আহত গণেশ সরকার আশঙ্কাজনক অবস্থায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি।

ছবিটা আলাদা ছিল না বীরভূমের মহম্মদবাজারে। এ দিন সকালে মহম্মদবাজারে মোরগ্রাম-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের বাসস্টপ থেকে মিছিল বার করেছিল সিপিএম। অশান্তির আশঙ্কায় পুলিশ আপত্তি জানালে পার্টি অফিস পর্যন্ত মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম। মিছিল দলের জোনাল অফিসের কাছে আসতেই লাঠি আর ইট-পাথর নিয়ে তৃণমূল কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। দলীয় অফিসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে। একটি আধলা ইট এসে পড়ে জোনাল সদস্য শ্রীজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মাথায়। পুলিশ কিছু করেনি বলে অভিযোগ। মার খান সাঁইথিয়ার সিপিএম বিধায়ক ধীরেন বাগদি, জোনাল সম্পাদক প্রভাস মাল। বিধায়ককে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হন তাঁর নিরাপত্তারক্ষী।

গোলমাল হয়েছে বর্ধমানের আউশগ্রামেও। বাজারে বেশির ভাগ দোকানই সকালে খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তখনই পতাকা, তির-ধনুক নিয়ে এসে সিপিএম কর্মীরা দোকান বন্ধ করতে বলেন। অভিযোগ, তখন তৃণমূলের লোকজন সিপিএমের দিকে বোমা ছুড়তে থাকে। পাল্টা তির ছুড়তে শুরু করেন ধর্মঘটীরাও। পুলিশ ধারে কাছে থাকলেও নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে এলাকায় বোমাবাজি হয়। চলে কয়েক রাউন্ড গুলিও। আউশগ্রাম থানার এক অফিসার বোমার ঘায়ে আহত হয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিকেলে আউশগ্রামের নওদায় তৃণমূলের দফতর ও এক নেতার বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। এই জেলারই রূপনারায়ণপুর মঙ্গলবার বিকেল থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে। রাতেও সেখানে গোলমাল চলে। সিপিএমের অভিযোগ, তাদের কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করেছে তৃণমূল।

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের ভ্যাবলা স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় ধর্মঘট সমর্থকেরা সকালে রেললাইনে বসে পড়ে ট্রেন অবরোধ করলে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের মারপিট বাধে। অভিযোগ, সিপিএমের এক যুবকর্মীকে চ্যাংদোলা করে লাইনের পাশে ডোবায় ছুড়ে ফেলা হয়। যোগেশগঞ্জ বাজারে দু’পক্ষের মারামারির সময়ে এক পুলিশকর্মী, দুই সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ জনা দ’শেক আহত হন। সিপিএমের পার্টি অফিসে তৃণমূল ভাঙচুর চালায় বলেও অভিযোগ। হুগলির চুঁচুড়ায় সিপিএমের জোনাল অফিসে ভাঙচুর চলে।

শাসকদলের বিরুদ্ধে এত জায়গায় হামলা চালানোর অভিযোগ উঠলেও তা উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মঘটের নামে সিপিএম গুন্ডামি করেছে। তাণ্ডব চালিয়েছে। মাটির সঙ্গে ওদের যোগ নেই। তাই গায়ের জোরে ধর্মঘট করছে। তা-ও মানুষ ওদের প্ররোচনায় পা দেননি।’’ বামেদের বিধায়ক ও প্রাক্তন সাংসদের মার খাওয়ার প্রশ্ন শুনে মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘তৃণমূল কেন সিপিএমকে মেরে হাত নষ্ট করবে?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘দলের ছেলেরা মাঝেমধ্যে জানতে চায়, কেন সিপিএম-ই শুধু আমাদের মারবে? কিন্তু আমি দলের ছেলেদের সংযত থাকতে বলেছি। এ দিনও ওঁরা সংযম দেখিয়েছে।’’ পুলিশ এ দিন বিরোধীদের প্রতি সৌজন্য দেখিয়েছে বলে তাঁর দাবি।

যা শুনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রাক্তন সাংসদ, বিধায়ক ধরে শুধু আমাদের রাজ্য কমিটিরই একাধিক সদস্য কী ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, সবাই দেখেছেন। বহু জায়গায় দলীয় কার্যালয় ঘিরে আক্রমণ হয়েছে। শুধু বহরমপুরের ঘটনার জন্যই আমাকে দু’বার স্বরাষ্ট্রসচিবকে ফোন করতে হয়েছে! বহরমপুরে আমাদের দলের নেতা গণেশ সরকারকে আহত অবস্থায় যে ভাবে তুলে নেওয়া যাচ্ছিল পুলিশ, তাতেই বোঝা যাচ্ছে কত সৌজন্য পুলিশ দেখিয়েছে!’’ দিনভর অজস্র আক্রমণ মোকাবিলা করেও ধর্মঘট ‘সফল’ করার জন্য সাধারণ মানুষ ও বামপন্থী নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।

Trinamool Police CPM left front
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy