Advertisement
E-Paper

ভিন্‌দেশি বেশে হাজির হলেন ঈশ্বর

অনুভূতি নেই, যন্ত্রণা নেই, কোনও স্মৃতিও নেই। চোখটা খুলে রেখেছি না বুজে, নিজেই বুঝতে পারছি না। শুধু কানে আসছে একটা ক্ষীণ শব্দ, ‘‘ওয়েক আপ... ওয়েক আপ!’’ এক জন বিদেশি ক্লাইম্বার আমার পিঠে হাত ঘষে ঘষে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। হাতে হাত ঘষছেন, কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছেন।

সুনীতা হাজরা (কাঠমান্ডুর হাসপাতাল থেকে ফোনে)

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০৪:০২
উদ্ধার হওয়ার পরে অ্যাম্বুল্যান্সে সুনীতা। কাঠমান্ডুতে।—কিংশুক চট্টোপাধ্যায়

উদ্ধার হওয়ার পরে অ্যাম্বুল্যান্সে সুনীতা। কাঠমান্ডুতে।—কিংশুক চট্টোপাধ্যায়

বাঁচব না, এ কথাটা মনে হচ্ছিল না তখন। মনে হচ্ছিল, আমি আর বেঁচেই নেই।

অনুভূতি নেই, যন্ত্রণা নেই, কোনও স্মৃতিও নেই। চোখটা খুলে রেখেছি না বুজে, নিজেই বুঝতে পারছি না। শুধু কানে আসছে একটা ক্ষীণ শব্দ, ‘‘ওয়েক আপ... ওয়েক আপ!’’ এক জন বিদেশি ক্লাইম্বার আমার পিঠে হাত ঘষে ঘষে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। হাতে হাত ঘষছেন, কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছেন।

মরা আমার আর হল না। ধীরে ধীরে মনে পড়ল, শনিবার এভারেস্ট সামিট ছোঁয়ার পরে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি আর গৌতমদা (ঘোষ)। তিন-তিন বার চেষ্টার পর সাফল্য এলে যেমন হওয়ার কথা আর কী! সঙ্গে একটু ভয়ও মিশছিল। তিনটে বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি নামতে হবে। অক্সিজেন প্রায় শেষের পথে। আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে। সাদা হয়ে যাচ্ছে চার পাশ। মন বলছিল, ভালয় ভালয় নামতে পারলে হয়!

শুক্রবার সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ ক্যাম্প ফোর থেকে বেরিয়েছিলাম। আমি, গৌতমদা, সুভাষ (পাল), পরেশদা (নাথ)। সঙ্গে চার জন শেরপা। সুভাষ আর পরেশদা প্রথম থেকেই একটু ধীরে চলছিল। ওদের উৎসাহ দিতে দিতেই আমি আর গৌতমদা একটু এগিয়ে যাই। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত। শরীর আর দিচ্ছে না। সামিটের প্রায় কাছাকাছি গিয়ে এক বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। খুব ভাল মনে নেই, কী হয়েছিল ঠিক। আমার শেরপা পাসাং হাত ঘষে, জল খাইয়ে জ্ঞান ফেরান।

সামিট তো ছুঁলাম। নামতে শুরু করার পরে আশঙ্কাটাই সত্যি হল। বিগড়ে গেল আবহাওয়া। প্রথমে আস্তে, তার পর জোরে... তুমুল হাওয়া। ব্যালকনি (সামিটের একটু নীচেই তুলনামূলক কম ঢালু একটা জায়গা) পর্যন্ত নেমে বুঝতে পারছিলাম, শরীরটা বশে নেই, মাথা টলছে। বসে পড়েছিলাম। গৌতমদা বোধহয় তখনই একটু এগিয়ে গিয়েছিল। পাসাং ছিল আমার সঙ্গে। একটা এনসিসি-র দলও সামিট করে নামছিল তখন। আমায় দেখে খুব মোটিভেট করল। বারবার বলল, ‘‘ঘর মে সব ইন্তেজার কর রহা হ্যায়... চলো চলো, চলনা পড়েগা।’’ আবার উঠে দাঁড়ালাম। আরও একটু নেমে দেখতে পেলাম সুভাষকে। আমাদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল ও। বুঝতে পারলাম, পারছে না আর। পরেশদা তখন কোথায়? জানা হয়নি আমার।

আবহাওয়া চরম খারাপ। আমার আর সুভাষের শেরপা সুভাষকে ধরে ধরে নামাতে শুরু করলেন। আমিও নামছি। একটা করে পা, একটা করে বড় নিঃশ্বাস। ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। কত ক্ষণ নেমেছিলাম? সময়ের হিসেব নেই। বুঝতে পারছিলাম, যে কোনও ভাবে নামতে হবে। কিন্তু শরীরে আর পারছিলাম না। এক সময় বোধহয় বসেই পড়লাম, ভাল মনে নেই। জ্ঞান ছিল না। তখনই ওই বিদেশি ক্লাইম্বারের আবির্ভাব।

এখন ভাবলে মনে হচ্ছে, তৃতীয় বার পুনর্জন্ম উনিই দিলেন। প্রথম বার, মানে ২০১৪ সালে খুম্বু আইসফলের দুর্ঘটনায় বেঁচেছিলাম স্রেফ বরাতজোরে। ঠিক সময়ে বেসক্যাম্প থেকে বেরোনো হয়নি বলেই আমরা বেঁচে যাই। ১৮ জন শেরপা সে বার মারা গিয়েছিলেন তুষারধসে। পরের বার, ২০১৫-র ভূমিকম্পে বেসক্যাম্পে বসে দেখেছিলাম চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে প্রায় আস্ত একটা পাহাড়ের ঢাল। পাথরে লুকিয়ে বাঁচিয়েছিলাম নিজেকে।

এ বার আর কোনও ভাবেই বাঁচার কথা ছিল না। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া খারাপ। অক্সিজেন শেষ। জ্ঞান নেই। ঈশ্বর...হ্যাঁ ঈশ্বরের মতোই এসে ওই ক্লাইম্বার আমার জ্ঞান ফিরিয়ে, নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডারটা লাগিয়ে দিলেন। কোথা থেকে এলেন উনি? শৃঙ্গ ছুঁতে বেরিয়ে পথে দেরি হয়ে গিয়েছিল, খারাপ আবহাওয়ায় আটকে গিয়েছিলেন। পরে বলেছিলেন, ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন এভারেস্টের টানে। নাম কী? জিজ্ঞেস করেছিলাম কি? মনে পড়ছে না তো! কোনও দিন হয়তো আর খুঁজে পাব না ওঁকে! জানানোই হবে না, আজও বেঁচে আছি ওঁর জন্যেই!

অক্সিজেন নিয়ে আবার নামতে শুরু করলাম ওঁর সঙ্গেই। শনিবার রাতেই ক্যাম্প ফোর অবধি পৌঁছতে পারলাম। বরফে তখন চার দিক একেবারে সাদা। নিজেদের টেন্ট খুঁজে পেলাম না। ওই বিদেশি ক্লাইম্বার আমাকে ওঁর টেন্টে থাকতে দিলেন। কতটা অবসন্ন ছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না। গ্লাভস খুলেই বুঝতে পারলাম, ফ্রস্ট বাইট শুরু হয়েছে ডান হাতে। গরম জল করে প্রাথমিক চিকিৎসাটা করলেন উনিই। এক জোড়া শুকনো গ্লাভসও দিলেন। ওঁর শেরপাও খুব যত্ন করছিলেন। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি। এক পাশে ওই অভিযাত্রী, এক পাশে ওঁর শেরপা।

রবিবার সকালে উঠে সবার প্রথমে আমাদের টেন্ট খুঁজে বার করলাম। সুভাষরাও খুব চিন্তা করছিল।

ওরা ভেবেছিল, নামতে পারিনি আমি। ক্যাম্প ফোর থেকে আবার একসঙ্গে নামতে শুরু করলাম চার জন। আমি, সুভাষ আর দু’জন শেরপা। ভাল ছিলাম না কেউই। তুষারঝড়, অন্ধকারে নামার ধকল, অক্সিজেনের ঘাটতি, তিন দিন পেটে কিছু পড়েনি— সব মিলিয়ে আর শক্তি ছিল না আমাদের। কমবেশি ফ্রস্ট বাইট তো সবারই হয়েছিল। শেরপারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে রোপ ধরে ধরে কোনও রকমে নামা। মাঝে মাঝেই বাড়ছিল হাওয়া। খুব আস্তে আস্তে নামছিল সুভাষ। কোনও ক্রমে ইয়েলো ব্যান্ড (ক্যাম্প ফোরের কাছাকাছি হলদে পাথুরে অংশ) পর্যন্ত নেমে সুভাষ বসে পড়ল। এই ভাবে বসে যেতে তো দিতে পারি না! সুভাষের মনের জোর ফেরাতেই হবে। ওকে বলতে লাগলাম, ‘‘চল সুভাষ, আর একটু...চল।’’ ওকে মোটিভেট করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বলছিলাম, যেতেই হবে।

আরও খারাপ হচ্ছে আবহাওয়া। তুষারঝড়ে দিকশূন্য অবস্থা তখন। সুভাষ চোখের সামনে ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানে এ ভাবে বসে পড়ার অর্থ কী..! ও কি আর পারবে না? কী অসহায় যে লাগছিল নিজেকে! তখন কত বেলা? জানি না। ডান হাতে অসহ্য যন্ত্রণা। একটা কোনও সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। একাই নামতে শুরু করলাম। শেরপাদের দেখতে পাইনি। ইয়েলো ব্যান্ড থেকে ক্যাম্প থ্রি— ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তাটা যে কী ভাবে নেমেছি, তার ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। শুধু একটাই কথা জানতাম, নামতে হবে। ক্যাম্প থ্রি-তে পৌঁছতে হবে। আর্যর (ছেলে) মুখটা মনে পড়ছে বারবার। মনে পড়ছে সুদেবের (স্বামীর) কথা।

খানিক ক্ষণ পরে আবহাওয়া একটু ভাল হল। হাওয়ায় তখনও বেশ জোর। টেন্টের আলোগুলো দেখতে পেলাম দূর থেকে। ক্যাম্প থ্রি!! একটা করে পা ফেলছি আর বলছি, ‘‘চল.. সুনী চল আর একটু..!’’ কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম এগিয়ে এসেছেন বিষ্ণু আর পাসাং। দুই শেরপা। ওঁদের কাছেই শুনলাম, নীচে যোগাযোগ করা গিয়েছে। হেলিকপ্টার রেডি আছে, আর একটু নামতে পারলেই হবে। ওঁরাই বললেন, গৌতমদা আর পরেশদাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ায় ওঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। সুভাষও রয়েই গেল।

প্রাণটা আকুলিবিকুলি করে উঠল সুদেবের গলাটা এক বার শোনার জন্য। ক্যাম্প টু-র কাছ থেকে হেলিকপ্টারে উঠলাম। পায়ে হেঁটেই গেলাম হেলিপ্যাড অবধি। লুকলায় নেমে ফোন করলাম সুদেবকে। ও কথা বলতে পারছিল না। আমারও গলা বুজেই যাচ্ছিল। কোনও মতে বললাম, ‘‘কী করে মরতাম বলো?’’

Mountaineer Sunita Hazara
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy