খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্ত-প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়েছে বারবার। উঠেছে গাফিলতির অভিযোগ। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) মাঠে নামার পরে তাদের সামনেই সেই গাফিলতির প্রশ্নে পরস্পরের ঘাড়ে দায় চাপানো শুরু করেছে বর্ধমান জেলা পুলিশ এবং সিআইডি।
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ ঘটে ২ অক্টোবর। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দল সেখানে যায় ৪ অক্টোবর। তার আগের দিনই ৫৫টি গ্রেনেড দামোদরের পাড়ে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের ঘটনায় দু’-একটি বিস্ফোরক তাঁরা আস্ত অবস্থায় সংগ্রহ করেন। তার ফলে কী ভাবে সেগুলি তৈরি হয়েছে, কোন সংগঠন বানিয়েছে, তা অনেক সময়ে ধরা যায়। কিন্তু ৩ অক্টোবর খাগড়াগড়ের সব গ্রেনেড ফাটানো হয়ে যাওয়ায় তাঁরা সে রকম নমুনা সংগ্রহ করতে পারেননি।
এই গ্রেনেড নষ্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে এনআইএ-র সামনে পরস্পরকে দুষেছে বর্ধমান জেলা পুলিশ এবং সিআইডি। সিআইডি-র দাবি, সেগুলি নষ্ট করেছে জেলা পুলিশ। জেলা পুলিশ আবার দাবি করে, সিআইডি-র নির্দেশ পেয়েই ওই বিস্ফোরক নষ্ট করা হয়েছে। বিস্ফোরক নষ্টের পরে তার বৈধতাপত্রে সিআইডি-র বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের এক সদস্য, জেলা পুলিশের দুই কর্তা, বর্ধমান সদর থানার ওসি, দমকলের অফিসার এবং এক জন চিকিৎসক সই করেছিলেন। সেখানে উল্লেখ করা রয়েছে, ডিআইজি সিআইডি (অপারেশনস)-এর নির্দেশে বোমাগুলি ফাটানো হয়েছে। সিআইডি-র (আইজি) আর শিবকুমার এবং রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, “সিআইডি অনৈতিক ভাবে আমাদের ঘাড়ে এই দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।” পক্ষান্তরে, সিআইডি-র বক্তব্য, তারা তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে ৫ অক্টোবর। ফলে, তার আগে যাবতীয় নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা তা নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত স্থানীয় পুলিশ নিয়েছে।
গত ২ অক্টোবর, মহাষ্টমীর দুপুরে বিস্ফোরণের পরে সন্ধ্যার মধ্যে জেলা পুলিশ জানতে পেরেছিল, এই ঘটনায় বাংলাদেশি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন জড়িত। তার পরেও ৫ অক্টোবরের আগে কাউকে গ্রেফতার করা বা তদন্তে চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যেই মূল পাণ্ডারা পালিয়ে যায়। জেলা পুলিশ খাগড়াগড়-কাণ্ডে জঙ্গিদের গোটা ‘মডিউল’ সম্পর্কে ধারণা করতে পারলেও চার জন বাদে আর কাউকে ধরতে পারেনি। সিআইডি-র দাবি, গোড়ার দিকে তদন্ত করছিল জেলা পুলিশ। ফলে, আরও বেশি সংখ্যায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে না পারার দায় তাদেরই। জেলা পুলিশের পাল্টা বক্তব্য, ৩ অক্টোবর সকালেই লিখিত ভাবে রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং সিআইডি-কে রিপোর্ট পাঠিয়ে তারা ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি-যোগের কথা জানিয়ে দিয়েছিল।
জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, মহাষ্টমীর দিন ঘটনা ঘটায় রাজ্য পুলিশের উঁচু তলা থেকে নির্দেশ যায়, তখনই জেহাদিদের কথা প্রকাশ্যে না আনতে। তাতে উৎসবের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হতে পারে বলে মত প্রকাশ করা হয়। তাই ৫ অক্টোবর পুজো মেটার পরে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি সাংবাদিক সম্মেলন করে জঙ্গি-যোগের কথা বলেন। জেলা পুলিশের ওই কর্তা বলেন, “৩ অক্টোবরই সিআইডি ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। তার পর থেকে জেলা পুলিশ তাদের সঙ্গেই কাজ করেছে। তাই ধরতে না পারার দায় শুধু জেলা পুলিশের উপরে বর্তাতে পারে না।”
ইতিমধ্যে তদন্তের অন্য দিক নিয়েও বিতর্ক বাধে। খাগড়াগড়ে জঙ্গি কার্যকলাপ ধরা পড়ার পরেও কেন জেলা পুলিশ ইউএপিএ (আনলফুল অ্যাক্টিভিটি প্রিভেনশন অ্যাক্ট) ধারায় মামলা করেনি, কেন তদন্তের দায়িত্ব তুলনায় জুনিয়র অফিসারদের হাতে দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এনআইএ-র তাগাদার পরে ইউএপিএ ধারায় মামলা করে সিআইডি। তার পরে এই ঘটনার তদন্তভার নেন এক ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার। এ প্রসঙ্গে সিআইডি-র বক্তব্য, প্রাথমিক মামলা জেলা পুলিশ করছিল। ইউএপিএ না দেওয়ার সিদ্ধান্তও তাদের। জেলা পুলিশের বক্তব্য, রাজ্য পুলিশের শীর্ষ মহলের পরামর্শমতো মামলার ধারা দেওয়া হয়েছিল।
এর পরে, এনআইএ তদন্তের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার দিন, শুক্রবার দু’দফায় খাগড়াগড়ের বাড়িটি থেকে নমুনা বের করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাতেও এনআইএ কর্তাদের সামনে প্রথমে জেলা পুলিশের উপরে দায় চাপায় সিআইডি। কিন্তু জেলা পুলিশ সেই দায় নিতে অস্বীকার করে। তার পরে সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট সব্যসাচীরমণ মিশ্র রিপোর্ট দিয়ে জানান, নমুনা সরানো হয়েছে তাঁদের নির্দেশেই।
পুলিশ-সিআইডি চাপান-উতোর একটা সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, শনিবার সিআইডি-র একটি দল খাগড়াগড়ে ফের যেতে চেয়েছিল নমুনা সংগ্রহের জন্য। কিন্তু এনআইএ-র দল জেলায় আসছে বলে খবর পেয়েই জেলা পুলিশ তাদের সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে বেঁকে বসে। এর জেরে শেষ পর্যন্ত সিআইডি-র আর ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy