Advertisement
০২ মে ২০২৪
Padma Awardee

হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনাই কাজ, বললেন মালদহের পদ্মশ্রী প্রাপক কমলি সরেন

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর জনজাতি সংগঠন ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর সক্রিয় কর্মী কমলি। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী আদিবাসী মানুষদের হিন্দুধর্মে ‘ফিরিয়ে আনা’ই প্রধান কাজ তাঁর। 

কমলি সোরেন।

কমলি সোরেন। —নিজস্ব চিত্র।

জয়শ্রী সিংহ
মালদহ শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ২১:২৪
Share: Save:

গরিব ঘরে জন্ম। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন কমলি। কিন্তু মালদহের মানুষ তাঁকে চেনেন ‘গুরুমা’ হিসেবে। সরেন পরিবারের সেই মেয়েই এ বার ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত। সমাজসেবার জন্য তাঁকে সম্মানিত করছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছ থেকে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিকের স্বীকৃতি গ্রহণ করবেন কমলি সরেন। সে খবর চাউর হতেই রাতারাতি গোটা মালদহ জুড়ে মুখে মুখে ফিরছে তাঁর নাম। জেলায় এমন কৃতিত্ব আর কারও নেই যে! তবে ঠিক কী কারণে তিনি পদ্মশ্রী পাচ্ছেন তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। তাঁর পদ্মশ্রী পাওয়ার সঙ্গে কেউ কেউ আবার ‘সাম্প্রদায়িক’ যোগও দেখছেন।

গাজলের ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের কোদালহাটি এলাকায় রাজেনবাবার আশ্রমই কমলির ধাম। ছোটবেলায় অসুখবিসুখ লেগেই থাকত। সে সবের ঝক্কি সামলাতে না পেরে তাঁকে আশ্রমে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। সেখানেই বড় হওয়া কমলির। পড়াশোনা বেশি দূর না এগোলেও, আশ্রমিক পরিবেশে ছোট বয়সেই ধর্মের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাঁর। ধর্মচিন্তা, ধর্মকথাই ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠতে থাকে। আশ্রমেই দীক্ষা হয়। আর তখন থেকে হিন্দু ধর্মের ‘মহত্ব’ মানুষের মধ্যে সঞ্চার করাই তাঁর লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে এখন। ধর্ম প্রচারই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। সে কাজ করতে গিয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর জনজাতি সংগঠন ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর সক্রিয় কর্মী কমলি। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী আদিবাসী মানুষদের হিন্দুধর্মে ‘ফিরিয়ে আনা’ই প্রধান কাজ তাঁর। ধর্মান্তরিত মুসলিমদেরও ‘মূল ধর্মে’ ফিরিয়ে আনার কাজ করেন কমলি। স্থানীয়দের দাবি, প্রথম জীবনে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে শুধু মানুষকে লক্ষ করতেন তিনি। তাঁদের ঘর-বাড়ি, জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখতেন। কারও বাড়িতে তুলসি গাছ না থাকলে, নিজে গাছ নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতেন। তুলসীদেবীর উপাখ্যান শোনাতেন সকলকে। ধর্মত্যাগী বা ভিন‌্‌ধর্মে দীক্ষিত হতে যাওয়া মানুষকে বুঝিয়েসুঝিয়ে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতেন। বিপদে আপদে তাঁদের সহায়ও হতেন। অসুস্থদের আশ্রমে নিয়ে এসে সেবাও করতেন।

তখন থেকেই এলাকাবাসী অনেকের কাছেই ‘গুরুমা’ হয়ে ওঠেন কমলি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিধাবিভক্ত এলাকার মানুষ। কারও কারও কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় হলেও, অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মানুষকে ধর্মান্তরণে বাধ্য করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০২০-র শুরুতে তেমনই একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন কমলিনী। সে বার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত আদিবাসী মেয়েদের হিন্দুধর্মে ফেরাতে গণবিবাহের আয়োজন হয় গাজলের আটমাইল এলাকায়। কমলি তার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বলে এলাকাবাসীর দাবি। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে এলাকাবাসীর একাংশের গোলমালও বাধে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, যেতে হয় পুলিশকে। সেই সময় তৃণমূলের তরফে জোর করে ধর্মান্তরণের অভিযোগ তোলা হয়। ধর্মান্তরণের জন্য পরিবার পিছু ১০-১২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ ওঠে।

সেই সময় গোটা ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভোটব্যাঙ্ক গড়তে আদিবাসী মানুষের ধর্ম নিয়ে খেলছে বিজেপি। মালদহে জোর করে বিয়ে দিয়ে আদিবাসী মেয়েদের ধর্মান্তরণ করার চেষ্টা করছিল। আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু মানবিকতা বোধ রয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিতে আর সমস্যায় পড়তে হবে না আদিবাসী মানুষকে। রাজ্য সরকারই গণবিবাহের আয়োজন করবে। তার জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে না।’’ পরে মমতার তদারকিতে সেখানে গণবিবাহের আয়োজন হয়।

তাই সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ কমলিকে সমাজকর্মীর আখ্যা দিয়ে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মালদহ জেলার তৃণমূলের মুখপাত্র শুভময় বসু বলেন, ‘‘সরকারের অনুগত থাকলে এমন ধর্মীয় সমাজ সেবিকাও সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পায়। গাজলের কমলি সোরেনের পুরস্কার পাওয়াটা তারই উদাহরণ। ভোটে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য পদ্মশ্রীর মতো সম্মানকে ব্যবহার করছে সরকার।’’

মালদহের জেলা সিপিএমের সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেন, ‘‘পদ্মশ্রী পেতে গেলে যে যোগ্যতা দরকার, তা দেখা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক সমীকরণকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মান্তরণ করালেই পদ্মশ্রী পাবে, কমলি সোরেনের ঘটনা তা প্রমাণ করে। এখন কোনও মাপকাঠি রাখা হচ্ছে না। এটা পুরোটাই রাজনৈতিক অভিসন্ধি।’’

সঙ্ঘের দিল্লির দফতর থেকেই বিভিন্ন রাজ্যে ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর কাজকর্ম পরিচালনা করা হয়। সঙ্ঘের ‘সুপারিশেই’ কমলিকে পদ্মশ্রী দেওয়া হয়েছে বলে জল্পনা শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গে সঙ্ঘের কর্মকর্তা তরুণ পণ্ডিত আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেন, ‘‘আদিবাসী মানুষের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন কমলি। ভিন্‌ধর্মে দীক্ষিত আদিবাসী মানুষকে মূল স্রোতে ফেরাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে তাঁর। তার জন্যই হয়ত ওঁকে বেছে নেওয়া হয়েছে।’’

কমলি নিজেও বলছেন সে কথা। কী কাজ করেন প্রশ্ন শুনে পদ্মশ্রী প্রাপক বললেন, “যে আদিবাসীরা অন্য ধর্মে চলে যায়, খ্রিস্টান হয়ে যায়, মুসলমান হয়ে যা, তাদের আমি হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।” কথাচ্ছলে উদাহরণও দিলেন। দৌলতপুরের এক আদিবাসী মেয়ের বিয়ে হয়েছিল মুসলিম পরিবারে। “তাঁকে ফিরিয়ে আনলাম। আবার হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল”, কমলি শোনালেন তাঁর কর্ম-সাফল্যের কাহিনীও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE