Advertisement
E-Paper

পুলিশ যখন নীতিপুলিশ! এখন প্রকাশ‍্যে মেয়েরাই বেশি মদ খায়, উচ্ছন্নে যাচ্ছে সমাজটা, রাজ্য পুলিশের কর্তার বচনে বিতর্ক

রাজ্য পুলিশের কর্তাকে একটি ভিডিয়োয় বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমার বলতে লজ্জা করছে। আপনাদের শোভাযাত্রায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ং মেয়েরা মদ খেয়েছেন। এটা যদি শোভাযাত্রার শোভা হয়, আমি এই শোভাযাত্রার নিন্দা করি।’’

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:২৩
নদিয়ার রানাঘাট পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার লাল্টু হালদারের মন্তব্যে বিতর্ক।

নদিয়ার রানাঘাট পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার লাল্টু হালদারের মন্তব্যে বিতর্ক। ছবি: সংগৃহীত।

ছেলেরা ‘বদমায়েশি’ করবেনই। মহিলাদের কাজ তাঁদের আটকানো। কিন্তু এখন মহিলারাই মদ খেয়ে ‘তাণ্ডব’ করে বেড়াচ্ছেন। তাতে ‘রসাতলে’ যাচ্ছে সমাজ। প্রকাশ্যে এই মত প্রকাশ করে বিতর্কে জড়ালেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা।

নদিয়ার রানাঘাট পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার লাল্টু হালদারের এই মন্তব্যের সমালোচনা করেছে বিভিন্ন মহল। বিতর্কের আবহে লাল্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। তিনি বলেন, ‘‘আমি শুধুমাত্র শান্তিপুরের কালীপুজো নিয়ে বলেছি। সেখানে তরুণীরা যে ভাবে প্রকাশ্যে মদ খেয়েছেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছি। শান্তিপুরে বামা কালী ভাসানের সময় যা দেখেছি, তা-ই বলেছি।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মদ খেয়ে অসভ্যতা করলে পুলিশ কিছু বলতে পারবে না?’’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল রানাঘাট পুলিশ জেলার সুপার আশিস মৌর্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘মহিলাদের আঘাত করার জন্য কিংবা তাঁদের সম্মানহানি করার জন্য কিছু বলা হয়নি। কালীপুজোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের কী কী করণীয়, সেই বিষয়ে অ্যাডিশনাল সাহেব (লাল্টু) ওঁর নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। কে কী খাবেন, কে কী পরবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। তবে ভিড়ের মধ্যে মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। ছেলেদের মদ খাওয়া দেখতে আমরা অভ্যস্ত। তবে এ বার মহিলাদের মদ্যপান নিয়ে যে নতুন প্রবণতা দেখা গিয়েছে, সেটা নিয়ে পুজো কমিটিগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে।’’

গত সপ্তাহে শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রস্তুতি বৈঠকে গিয়েছিলেন লাল্টু। সূত্রের খবর, সেখানে জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্যোক্তার সামনে ভাষণ দেন তিনি। সেই ভাষণেরই একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। সেটির সত্যতা আনন্দবাজার ডট কম যাচাই করেনি। যদিও লাল্টু কিছুই অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘এই কথাগুলো বলা হয়েছিল রাস ও জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্যোক্তাদের। এই ভিডিয়ো কী ভাবে বাইরে এল, জানি না।’’

ভিডিয়োটিতে লাল্টুকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমার বলতে লজ্জা করছে। আপনাদের শোভাযাত্রায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ং মেয়েরা মদ খেয়েছেন। এটা যদি শোভাযাত্রার শোভা হয়, আমি এই শোভাযাত্রার নিন্দা করি। বাড়ির মেয়েরা যদি এ রকম হয়ে যান, তবে সমাজ উচ্ছন্নে চলে যায়। মহিলাদের বাগে আনা যাচ্ছে না।’’

পুজো উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে লাল্টু বলেন, ‘‘মহিলারা যে ভাবে অত্যাচার করছেন, অন্যায় ভাবে প্রশাসনের সঙ্গে অসহযোগিতা করছেন, আপনারা এটা খেয়াল রাখুন। আপনারা ভাববেন না যে, পুলিশের সঙ্গে হচ্ছে, আমাদের কী! এটা ঘরে ফিরবে। ফিরছেও। উৎসব এক দিনের। তার পর ঘরে ফিরে দাম্পত্যকলহ। এ সব কিন্তু এক দিনে আসেনি। প্রশ্রয় পেয়ে এই সব হচ্ছে।’’

ওই পুলিশকর্তার আরও দাবি, এখন ছেলেদের থেকে মেয়েরাই বেশি মদ খান, যা সমাজকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েরা বাড়িতে মদ খেয়ে এসে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে গন্ধ বেরোচ্ছে। এটা দেখতে খারাপ লাগে। সত্যি কথা বলতে, ছেলেদের থেকে মেয়েরাই বেশি মদ খাচ্ছে। এ বছর কালীপুজোর শোভাযাত্রায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদ খেয়েছে। এটা লজ্জার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।’’

লাল্টুর মন্তব্যে নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরেই প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। শান্তিপুরের রাধারানি নারী শিক্ষা মন্দির স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তপতী দাস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের এই মন্তব্য সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। শুধুমাত্র মহিলাদের মদ্যপানেই সমাজ উচ্ছন্নে যায়— এই ব্যাপারটা এত সরলীকরণ করা ঠিক নয়। এক জন মহিলা সংসারের জন্য কতটা লড়াই করেন কল্পনাও করা যায় না। এই মন্তব্যে কোথাও সেটা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। কোথাও কেউ আইন ভঙ্গ করলে, গোটা সমাজের বিরুদ্ধে এ ভাবে নীতিপুলিশগিরি করা ঠিক নয়। পুলিশকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, সব কিছুর দায় নারীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়াটা একদমই কাঙ্ক্ষিত নয়।’’

সমাজকর্মী ও লেখিকা প্রিয়দর্শিনী বসু বলেন, ‘‘অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বক্তব্যের মধ্যে একটা ভীষণ রকম সুপ্ত পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। প্রশাসনের এ রকম উচ্চপদে থেকে মহিলাদের প্রতি এই ধরনের মন্তব্য করা যায়? সাহস-স্পর্ধা-ক্ষমতার নিশ্চয়তা না-থাকলে উনি হয়তো করতেন না। অবিলম্বে ওঁর এই পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। কারণ, গার্হস্থ্যহিংসা কিংবা মহিলা নির্যাতনের কোনও ঘটনার অভিযোগ নিয়ে ওঁর কাছে কেউ এলে উনি ধরেই নেবেন, এর নেপথ্যে মহিলাদের মদ্যপানের প্রবণতাই দায়ী। এর পরেও এই পুলিশ আধিকারিক কী করে এই পদে থাকতে পারেন, জানি না।’’

রানাঘাট কলেজের চতুর্থ সেমেস্টারের ছাত্রী শ্রুতি মুখোপাধ্যায়ের কথায়,
‘‘মহিলাদের জন্য মদ্যপান কি সরকার নিষিদ্ধ করেছে? বিশ্বের কিছু দেশে এই ধরনের মানসিকতা রয়েছে। সে দেশগুলিকে আমরা অন্ধকারের দেশ বলি। অবিলম্বে এই মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়া উচিত। মহিলারা কী খাবেন, কী পরবেন, এ সব কি এখন পুলিশ ঠিক করবে? এর জন্য কি কোনও ‘পুলিশিং কোড অফ কন্ডাক্ট’ চালু হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। যিনি এই মন্তব্য করেছেন, তাঁর কাছে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের উত্তর আছে। মহিলাদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করার জন্য কেন ওঁর বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?’’

নদিয়ার নৃত্যশিল্পী রমা মজুমদার বলেন, ‘‘এটা শান্তিপুর। কাবুল কিংবা কন্দহর নয়। অ্যাডিশনাল এসপি এটা গুলিয়ে ফেলেছেন। মহিলাদের অযাচিত জ্ঞান না দিয়ে, বাইপাসের ধারের ধাবাগুলোতে যে অবৈধ মদের ঠেক চলে, আগে সেগুলো বন্ধ করুন। অবৈধ মদের ব্যবসায় যারা প্রশ্রয় দেন, তাঁদের মুখে মহিলাদের মদ্যপান নিয়ে মন্তব্য হাস্যকর।’’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “শান্তিপুরের পুণ্যভূমিতে হয়তো কোনও বিদ্যাসাগর কিংবা রামমোহনের পুনর্জন্ম নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। জেন জ়ি-র জমানায় মদ্যপান আনন্দ উদ্‌যাপনের একটি অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কোনও প্রশাসনিক কর্তার আচরণে লিঙ্গভিত্তিক মানসিকতা প্রকাশ পাওয়াটা কাম্য নয়। বাড়িতে ঢুকে যখন এক জন মহিলাকে গুলি করে খুন করা হয়, তখন পুলিশের সক্রিয়তা আরও বেশি কাম্য। শোভাযাত্রায় নারীদের ভূমিকা নিয়ে নয়।’’

Moral Police Nadia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy