Advertisement
E-Paper

লেক মল বাঁধা দিয়ে ধার পাবে ভেঙ্কটেশ

ষাট বছরের চুক্তি-মেয়াদ তিরিশ বছর করে দু’ভাগে ভাঙা হয়েছে। যার সুবাদে লেক মল লিজের স্ট্যাম্প-ডিউটি বাবদ রাজ্য সরকারের প্রাপ্য ২৪ কোটি টাকা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে করে দেওয়ার জন্য কলকাতা পুর-কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে আগেই।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:৫৯

ষাট বছরের চুক্তি-মেয়াদ তিরিশ বছর করে দু’ভাগে ভাঙা হয়েছে। যার সুবাদে লেক মল লিজের স্ট্যাম্প-ডিউটি বাবদ রাজ্য সরকারের প্রাপ্য ২৪ কোটি টাকা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে করে দেওয়ার জন্য কলকাতা পুর-কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে আগেই। এ বার লিজগ্রহীতা সংস্থাটি যাতে মল বন্ধক রেখে ছ’কোটিরও বেশি টাকা ব্যাঙ্ক-ঋণ নিতে পারে, সে ব্যাপারে তৎপর হয়েছে তৃণমূলশাসিত পুরবোর্ড। যার প্রেক্ষাপটে লেক মল-বিতর্কে জুড়ে গিয়েছে নতুন মাত্রা।

পুর-সূত্রের খবর: ভেঙ্কটেশকে ঋণের সুযোগদান সংক্রান্ত প্রস্তাবটি সম্পর্কে সম্প্রতি মেয়র পরিষদের বৈঠকে ‘ইতিবাচক’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। আজ, বৃহস্পতিবারের পুর-অধিবেশনেই সেটি পাশ করার জন্য তোলার কথা। ঘটনা হল, মেয়াদ দু’ভাগে ভেঙে নতুন ভাবে করা লিজ-চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাধীন বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন নানা মহলে। অর্থ দফতরের এক আমলার সাফ কথা, ‘‘ওই চুক্তি করা ঠিক হয়েছে কি না, তা নিয়েই মামলা চলছে। ফলে চুক্তিটির ভিত্তিতে অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।’’

শুধু নবান্ন নয়, খাস পুরভবনের অন্দরেও সংশয়ের সুর। আধিকারিকদের একাংশের মতে, লেক মল পুনর্গঠনের আগে ডেভেলপার সংস্থাকে এ ভাবে ব্যাঙ্ক-ঋণ গ্রহণের অধিকার দিলে বিশেষ আপত্তি ছিল না। ‘‘কিন্তু এখন তো কাজ শেষ! দু’বছর আগে মলের উদ্বোধনও হয়ে গিয়েছে। এখন এই সিদ্ধান্তের কারণ কী?’— প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা। প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এটা নিঃসন্দেহে আর একটা দুর্নীতি।’’

মেয়র অবশ্য তা মানেন না। ‘‘যা হয়েছে, আইন মেনেই হয়েছে।’’— দাবি তাঁর। শোভনবাবুর যুক্তি, ‘‘ভেঙ্কটেশ হল লেক মলের লেসি। সেই হিসেবে ওরা ঋণ নিতেই পারে। পুরসভার আইন দফতরের পরামর্শ মতোই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ পুর-প্রশাসনের এক কর্তার আরও যুক্তি, ‘‘নতুন লিজ-চুক্তিতে শর্তই ছিল যে, লিজগ্রহীতা মল বন্ধক রেখে ব্যাঙ্ক-ঋণ নিতে পারবে। কাজেই শর্ত মানতে হয়েছে।’’ যা শুনে কিছু পুর-আধিকারিকের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভেঙ্কটেশের আবেদনেই তো পুরবোর্ড এমন শর্তে রাজি হয়েছিল! এখন সেই অজুহাত দেওয়ার অর্থ কী?’’

লেক মল পুনর্গঠনের ব্যাপারে ১৯৮৭-তে পুরসভা চুক্তি করেছিল অরুণ প্লাস্টিক প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে, পরে যার নাম হয় ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন। ‘ডেভেলপার’ হিসেবে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি লিজে পরিণত হয় তৃণমূল বোর্ডের আমলে— আদতে ষাট বছরের মেয়াদ দু’ভাগে ভেঙে প্রথম তিরিশ বছর (২০১৩-২০৪৩) ভেঙ্কটেশের সঙ্গে লিজ-চুক্তি, পরবর্তী তিরিশ বছরের (২০৪৩-২০৭৩) জন্য ভেঙ্কটেশেরই সুপারিশমাফিক তার ‘নমিনি’ সংস্থার সঙ্গে লিজ-চুক্তি। ভেঙ্কটেশের সঙ্গে প্রথম তিরিশ বছরের চুক্তির রেজিস্ট্রি সরকার করে দিয়েছে। ‘বিএম লেসার এলএলপি’ নামে অন্য সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি অবশ্য এখনও রেজিষ্ট্রি হয়নি।

কিন্তু এখানেই অন্য বিতর্ক— ২০৪৩ সালের পরে কে লেক মলের লিজ পাবে, তার ব্যবস্থা এখনই সেরে ফেলার যুক্তি কী? এ ক্ষেত্রে ভেঙ্কটেশের ‘নমিনি’ সংস্থাকেই কেন বাছা হল, সে প্রশ্নও প্রকট। বস্তুত এ নিয়ে গত অক্টোবরের পুর-অধিবেশনে বাম-বিজেপি-কংগ্রেস কাউন্সিলরেরা তীব্র আপত্তি তুলেছিলেন। জবাবে মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার বলেন, ষাট বছরে দু’টো কেন, দশটা সংস্থার সঙ্গেও চুক্তি হতে পারত। বিএম লেসার প্রসঙ্গে মেয়রেরও দাবি, ‘‘যা করার আইন মেনেই করা হয়েছে।’’

পুর-সূত্রের খবর: প্রথম চুক্তি রেজিস্ট্রি হতেই ভেঙ্কটেশ লেক মল বন্ধক রেখে ঋণ জোগাড় করতে উঠে-পড়ে লাগে। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, সম্পত্তিটি যে হেতু পুরসভার, তাই পুর-কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে এ ভাবে ঋণ দেওয়া যাবে না। সেই অনুমতির জন্য ভেঙ্কটেশের তরফে পুরভবনে তদ্বির শুরু হয়। গোড়ায় অফিসারেরা প্রস্তাবটি আটকে রেখেছিলেন। এর পরে পুরভোটের ডামাডোলে বিষয়টা চাপা পড়ে যায়। পুরভোট মিটতে ভেঙ্কটেশ আবার সক্রিয় হয়। গত ১৯ মে নতুন পুরবোর্ডের মেয়র পরিষদে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলে ভেঙ্কটেশের প্রস্তাবে সবুজ সঙ্কেত মিলেছে। চুক্তির বয়ান কী হবে, তা-ও স্থির হয়ে গিয়েছে।

তা হলে অন্য যে সব সংস্থা পিপিপি মডেলে বিভিন্ন পুর-বাজার সংস্কার করছে, তারাও কি ভেঙ্কটেশের মতো ঋণের সুযোগ পাবে?

মেয়রের দাবি, পাবে। ‘‘চুক্তির শর্ত মেনে চললে তারাও এ ভাবে ঋণ পেতে পারে।’’— মন্তব্য শোভনবাবুর। কিন্তু ঋণ না-শুধলে? তা হলে তো ‘বন্ধকী’ মল বা মার্কেটের দখল ব্যাঙ্ক নিয়ে নেবে! অর্থাৎ, সে ক্ষেত্রে পুরসভার সম্পত্তি বেহাত হতে পারে। এমন সম্ভাবনা যে থাকছে, কিছু পুর-কর্তার কথায় তার ইঙ্গিত মিলেছে। আর মেয়রের বক্তব্য, ‘‘ওই সম্পত্তি অন্য কাউকে লিজ দিয়ে ব্যাঙ্ক টাকা তুলতে পারবে। পুরসভার পাওনাও ফেরত দিতে পারবে। ঋণের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে তেমনই লেখা হচ্ছে।’’

পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন সামনে আসছে। কী রকম?

পুর-সূত্রের খবর: ২০১৩-র ১৪ অগস্ট নবরূপে গড়ে ওঠা লেক মলের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনও ভেঙ্কটেশের সঙ্গে লিজ-চুক্তি হয়নি। কিন্তু তার আগে থেকেই মলের উপরের তলাগুলোয় বেশ কয়েকটা দোকান চালু ছিল, যাদের পুরসভাও সাব-লিজের অধিকার দেয়নি। অথচ নিয়ম মোতাবেক ওখানে ব্যবসা করতে হলে লিজের চুক্তিপত্র দিয়ে লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। ‘‘কোন চুক্তি দেখিয়ে দোকানগুলো পুরসভার লাইসেন্স পেল?’’— জানতে চাইছেন পুর-কর্তাদেরও অনেকে।প্রশ্নটা মেয়রকেও করা হয়েছিল। শোভনবাবু শুধু বলেছেন, ‘‘খবর নিয়ে দেখতে হবে।’’ পুরভবনের খবর, লেক মল ‘কেলেঙ্কারি’ ফাঁস হওয়ার পরে পুরসভার বাজার দফতরের তরফে লাইসেন্স দফতরের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। লাইসেন্স দফতর সংশ্লিষ্ট নথি দিতে রাজি হয়নি। আবার ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে ভেঙ্কটেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত লিজ-চুক্তির বয়ান অনুযায়ী, সেটি বলবৎ হয়েছে তার এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৩-র ১২ অগস্ট থেকে। কী ভাবে এমনটা হতে পারে, পোড়-খাওয়া পুর-আধিকারিকদেরও মাথায় ঢুকছে না!

ক’দিন আগে লেক মলে অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সংশয়ের পারদ আরও চড়েছে। পুর-সূত্রের খবর, ঘটনার পরে মেয়র-সহ পদস্থ অফিসারেরা গিয়ে দেখেছিলেন, সিঁড়িতে ডাঁই করে রাখা রয়েছে প্লাস্টিক ও কাপড়চোপড়ের মতো দাহ্য পদার্থ। তার পরেও লেসি সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

কেন? মেয়র বলেন, ‘‘সংস্থাটিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’

এখানেই ইতি। মলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুরসভা বা ভেঙ্কটেশ, কারও তরফেই কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এবং এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি। কারণ, তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি।

সব মিলিয়ে ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকেই আজ পুর-অধিবেশনে পেশ হতে চলেছে ভেঙ্কটেশকে ঋণ পাওয়ানোর প্রস্তাব।

Anup Chattapadhya Lake mall KMC Trinamool BJP Shree Venkatesh Films Venkatesh foundation abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy