প্রশ্নটা উঠেছিল বাম আমলেই। গুজরাতের আমুল বা বিহারের সরকারি সুধা— সাফল্যের এমন সব উদাহরণ হাতের কাছে মজুত থাকতেও পশ্চিমবঙ্গের মাদার ডেয়ারি কেন ব্যর্থতার গণ্ডিতে বাঁধা?
উত্তরটা মিলল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায়। আমুল, কিংবা বিহারি সুধার সাফল্যকে এখনও ছোঁয়া যায়নি ঠিকই। তবে এ রাজ্যে পরিবর্তনের সরকার মাদার ডেয়ারির গায়ে কর্পোরেটের জামা পরিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছে। তাতেই লাভের ছোঁয়া লেগেছে নুইয়ে পড়া সরকারি সংস্থাটির গায়ে।
রাজ্যের দুগ্ধ ও পশুপালন দফতরের হিসেবের খাতায় ছবিটা পরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে মাদার ডেয়ারি যেখানে সাড়ে চার কোটি টাকা লোকসান করেছিল, সেখানে পরের বছরে (২০১৫-১৬) লাভ হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি। চলতি অর্থবর্ষের (২০১৬-১৭) প্রথম তিন মাসে মুনাফার অঙ্ক দু’কোটির সীমা পার! কিন্তু বাম রাজত্বের গোড়ায় (১৯৭৮ সালে) যার জন্ম, লাভের মুখ দেখতে তার কেন প্রায় চার দশক লেগে গেল?
কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: একটা উদ্যোগকে লাভজনক করে তুলতে যে রকম বাণিজ্যমনস্কতা দরকার, এ ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি ছিল। এ বার কর্পোরেট ধাঁচে পেশাদারিত্বের সঞ্জীবনী প্রয়োগ করে প্রায় রুগ্ণ সংস্থাটিকে ঘুরে দাঁড় করানো হচ্ছে।
এবং এই সাফল্য-যাত্রায় তাঁরা বেছে নিয়েছেন আমুলের দেখানো পথ। যেমন, লাভের টাকার সিংহভাগ খাটছে ব্যবসার পরিসরবৃদ্ধিতে। বিভিন্ন মিল্ক ইউনিয়নের উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত দুধ (প্রসেসড মিল্ক) ও দুগ্ধজাত পণ্য কিনে মাদার ডেয়ারি নিজের নামে বেচছে, আমুল যেমনটি করে থাকে। কর্তারা জানাচ্ছেন, আগে আমুলকে দুধ বেচে উৎপাদকেরা বেশি দর পেতেন। গত সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্য সরকারও ২৫% বেশি দামে দুধ কিনছে। যদিও সে জন্য ডেয়ারির পণ্যের দাম বাড়ানো হয়নি। কারণ, উৎপাদকদের বাড়তি দাম দেওয়ায় সংস্থার ঘাড়ে বাড়তি খরচের বোঝা চাপছে বটে, তবে ব্যবসায় সার্বিক বৃদ্ধির সুবাদে তা বহন করা কঠিন হচ্ছে না। সংস্কারমুখী বিবিধ পদক্ষেপের দরুণ আয় যে হারে বেড়েছে, তাতে এটা দিব্যি পুষিয়ে যাচ্ছে বলে সংস্থা-কর্তৃপক্ষের দাবি। ‘‘দাম বাড়ালে ক্রেতা আকর্ষণের প্রক্রিয়া ধাক্কা খেত। এমন পরিস্থিতি হয়নি।’’— বলছেন
এক আধিকারিক।
এমতাবস্থায় রায়গঞ্জের কুলিক বা গুসকরায় মিল্ক ইউনিয়ন মারফত আসা কয়েক হাজার টন প্রসেসড মিল্ক মাদার ডেয়ারির নামে বিকোচ্ছে। বাঁকুড়া, নদিয়া, মেদিনীপুরেও তা-ই। দফতরের দাবি, ইদানীং মাদার ডেয়ারির দুধের দৈনন্দিন চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত দু’লক্ষ লিটার। রোজ দুগ্ধজাত পণ্যের গড় বিক্রি পাঁচ হাজার কেজি।
বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে বিপণনকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে। উত্তরবঙ্গে বড় মাপের উৎপাদনকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে। পাঁচ বছর আগেও মাদার ডেয়ারির কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দক্ষিণবঙ্গে। তখন সারা রাজ্যে বিক্রয়কেন্দ্র ছিল ১২০০। এখন ৩২০০। সবই বেসরকারি হাতে চালানোয় সংস্থার খরচ কমছে। কাঁচামাল বা পণ্যের পরিবহণ ও সংশ্লিষ্ট খরচে রাশ পড়েছে। রেফ্রিজারেটর-গাড়ির সুবাদে পণ্যের গুণমানও ঠিক থাকছে।
বস্তুত বাংলার ঘরে ঘরে ‘মাদার ডেয়ারি’ ব্র্যান্ডের কদর বাড়াতে হলে জিনিসের মান বাড়ানো যে সবচেয়ে জরুরি, কর্তারা বারে বারে সেটাই বলছেন। একই সঙ্গে ক্রেতা আকর্ষণের তাগিদে আমুলের মতো পণ্যে বৈচিত্র্য আনায় নজর পড়েছে। হরেক স্বাদের দুধ, মাখন, চকোলেটের পাশাপাশি দই, ঘোল, আইসক্রিম, চিজ, লস্যি ইত্যাদি বাজারে ছেড়ে সাড়া পেয়েছে আমুল। মাদার ডেয়ারিও সেই কায়দা নিয়েছে। কী রকম?
মাদার ডেয়ারির আউটলেটে কোলেস্টেরল ফ্রি দুধ থেকে কাউ মিল্ক— মোট ছ’রকমের দুধ মিলবে। বাচ্চা থেকে বুড়ো— সবার পছন্দমাফিক ‘আইটেম’ও রাখার চেষ্টা হচ্ছে। তালিকায় আছে আইসক্রিম, প্রোবায়োটিক দই, ইয়োগার্ট, মিষ্টি, পনির, ঘি-সহ মোট ২৮টি দুগ্ধজাত পণ্য। এমনকী, আমিষও। মাদার ডেয়ারির বিপণন-অধিকর্তা সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘নাগেটস, সসেজের মতো চিকেনের নানা আইটেম এখনকার ছেলেমেয়েরা ভালবাসে। আমরা সেগুলো রাখছি। কোয়েলের ডিম, মাংসও।’’ এ সব যাতে মানুষ জানতে পারেন, সে জন্য প্রচারেও খামতি নেই।
অর্থাৎ রকমারি পণ্যের মারকাটারি মার্কেটিং। কর্তারা একটি ঘটনা শোনাচ্ছেন। এক বার পাহাড়ে গিয়ে ম্যাঙ্গো পুডিং খেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাল লেগেছিল। ‘‘ওঁর মুখে শুনে আমরাও ম্যাঙ্গো পুডিং বানিয়ে ফেললাম। এটা এখন বিরাট হিট আইটেম।’’— বলছেন সঞ্জীববাবু।
পেশাদারিত্বের ছোঁয়া পেয়ে মাদার ডেয়ারি কি আমুলকে ধরে ফেলল?
সংস্থার চিফ জেনারেল ম্যানেজার দেবব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমুল এখনও অনেকটা এগিয়ে। তবে আমরা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ ছোড়ার জায়গায় পৌঁছেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy