হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মারধরে জখম শাশ্বতী ঘোষকে।
ছিল সামান্য একটা দুর্ঘটনা। কেউ সে ভাবে জখমও হননি। কিন্তু রবিবার দুপুরে সেই ‘তিল’ই শেষ পর্যন্ত ‘তাল’ হয়ে দাঁড়াল হাবরায়। এক তৃণমূল কাউন্সিলরের ‘দাদাগিরি’র জেরে এক দম্পতি এবং তাঁদের এক আত্মীয়া মার খেলেন বলে অভিযোগ। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই আত্মীয়াকে বারাসতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ-তে ভর্তি করানো হয়েছে। কাউন্সিলরের অনুগামীরা ঘুষি মেরে তাঁর নাক ফাটিয়ে দেয় বলে অভিযোগ।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় কর্মীদের পই পই করে বলছেন, জোরজুলুম বা মাতব্বরি তিনি সহ্য করবেন না। সক্রিয় হওয়ার বার্তা দিয়েছেন প্রশাসনকেও। সম্প্রতি দলের ঘনিষ্ঠমহলে নেত্রী বলেন, কলকাতা ও শহরাঞ্চলের কিছু কাউন্সিলর কী পরিমাণ দৌরাত্ম্য চালাচ্ছেন, তা ঘরে বসেই টের পাচ্ছেন তিনি! ইতিমধ্যে তোলাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বিধাননগরের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা আগেই জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে নিজের চেষ্টায় দলের যে ভাবমূর্তি মমতা তৈরি করেছেন, কিছু নেতা-নেত্রীর জন্য তাতে যথেষ্ট কালি লেগেছে। এটা যে তিনি আর মেনে নেবেন না, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন নেত্রী।
তার পরেও অবশ্য জেলায় জেলায় শাসকদলের একাংশের ‘দাদাগিরি’ চলছে। দিন কয়েক আগে মেদিনীপুরে একটি পেট্রোল পাম্পে বিনা হেলমেটে তেল নিতে না পেরে পাম্পকর্মীদের উপরে হম্বিতম্বি করেন জেলা যুব তৃণমূল নেতা সৌরভ বসু। তার ঠিক আগেই কামারহাটিতে তোলাবাজির অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের এক মহিলা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। বিষয়টি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং পুলিশকে জানানোর ‘অপরাধে’ এক দলীয় কর্মীকে খুনের চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। সদ্য গত বৃহস্পতিবার বিডিও-র স্ত্রী-মেয়েকে মারধরের অভিযোগ ওঠে কোন্নগরের তৃণমূল কর্মী বাপি দাসের বিরুদ্ধে। দু’দিন পর বাপিকে গ্রেফতারও করা হয়। এ বার হাবরার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর গৌতম বিশ্বাসের উপস্থিতিতে তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ উঠল।
তৃণমূল কাউন্সিলর গৌতম বিশ্বাস।
কী হয়েছিল এ দিন? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, হাবরা শহরের হিজলপুকুরে অসুস্থ শ্বশুরকে দেখতে এসেছিলেন বেলঘরিয়ার বাসিন্দা অনুপম সাহা। সঙ্গে স্ত্রী শতাব্দীদেবী এবং দু’বছরের ছেলে অগ্নিভ। দুপুরে শ্যালিকা শাশ্বতী ঘোষ এবং স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে হাবরা বাজারে যান অনুপম। সেখান থেকে ভ্যানে করে ফিরছিলেন তাঁরা। হাবরা থানার কাছে যশোর রোডে একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে কাউন্সিলর গৌতমবাবুর মোটরবাইক একটি যাত্রিবাহী গাড়িতে ধাক্কা মারে। সেই গাড়িটি ধাক্কা দেয় অনুপমবাবুদের ভ্যানে। স্ত্রী, পুত্র, শ্যালিকা-সহ রাস্তায় পড়ে যান অনুপমবাবু। তখন ওই গাড়ির চালক জানান, বাইকের ধাক্কায় তিনি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। পাশের পাম্পে তখন তেল নিতে ঢুকেছেন গৌতমবাবু। অনুপমবাবু তাঁর কাছে গেলে শুরু হয় বচসা। একটু পরেই কয়েক জন যুবক এসে অনুপমবাবু ও তাঁর স্ত্রী-শ্যালিকাকে মারধর করে বলে অভিযোগ।
গোলমাল দেখে স্থানীয় কয়েক জন এগিয়ে আসেন। তত ক্ষণে শাশ্বতীর নাক-মুখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় তাঁকে হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান অনুপমবাবু। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁকে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। তাঁকে বারাসতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ-তে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সামান্য উন্নতি হলেও শাশ্বতীদেবীর অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। ঘটনার পরে গৌতমবাবুও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে যান।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনুপমবাবু বলেন, ‘‘তর্কাতর্কির সময় হঠাৎ কয়েক জন যুবক এসে আমাদের বলে, কার সঙ্গে কথা বলছিস জানিস! উনি কাউন্সিলর।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এর পরেই শুরু হয় মার। আমার শ্যালিকার মুখে ঘুষি মারা হয়। কাউন্সিলরও আমাদের গায়ে হাত তোলেন।’’ এই অভিযোগ মানতে চাননি গৌতমবাবু। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘আমি পাম্পে তেল নিতে ঢুকেছিলাম। তখনই ওই ব্যক্তি আমাকে গালিগালাজ করেন, ঘুষি মারেন। লোকজন এলে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়। তবে ওঁদের কেউ মারেনি।’’ প্রত্যক্ষদর্শীরা কিন্তু গোটা ঘটনার জন্য গৌতমবাবুকেই দুষছেন।
হাসপাতালে গিয়ে শাশ্বতীর বয়ান নথিভুক্ত করেছে পুলিশ। জেলার এসপি ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানান, ওই বয়ানের উপরে ভিত্তি করে মামলা রুজু করা হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানান, দলের কেউ দোষী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। তিনি বলেন, ‘‘সব সভাতেই কর্মীদের বলছি, আপনাদের ব্যবহারে মানুষ যেন দুঃখ না পায়। আমাদের আরও সংযমী হতে হবে।’’
ছবি: শান্তনু হালদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy