প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের কারা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহকে ইডি নিজেদের হেফাজতে নিতে পারবে, নাকি তিনি জামিনেই থাকবেন, তা জানা যাবে মঙ্গলবার। তবে শনিবার কলকাতার বিচার ভবনে এই মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালতের উপর আস্থা রাখার কথাই জানালেন চন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, “বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা ছিল, আস্থা আছে, ভবিষ্যতেও আস্থা থাকবে।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি তদন্তে সহযোগিতা করছেন না বলেছে ইডি? জবাবে উনি না বলেন। তিনি প্রভাবশালী কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরেও না বলেন মন্ত্রী।
প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় চন্দ্রনাথকে সাত দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়েছিল ইডি। মন্ত্রী তদন্তে সহযোগিতা করছেন না বলে আদালতে অভিযোগ করে ইডি। পাল্টা মন্ত্রীর আইনজীবী বলেন, অসহযোগিতার প্রশ্নই আসছে না। কেন এখনও ইডি তদন্ত শেষ করতে পারছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন চন্দ্রনাথের আইনজীবী। বয়ান নথিবদ্ধ করার পরেও কেন ১১ মাস পরে চার্জশিট দাখিল করা হল, তা নিয়ে ইডিকে প্রশ্ন করেন বিচারকও। জবাবে ইডির আইনজীবী বলেন, “তল্লাশি এবং বয়ান নথিবদ্ধ করার মাঝে পঞ্চম চার্জশিট জমা পড়েছে। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিল। আধিকারিকেরা সেই দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এর মাঝেও তদন্ত এগিয়েছে।”
চন্দ্রনাথের আইনজীবী হেফাজতের বিরোধিতা করে আদালতে বলেন, পরবর্তী তদন্তের জন্য অন্য যে কোনও শর্ত দেওয়া হোক।” আদালত বললে চন্দ্রনাথ ইডির কাছে তদন্তের স্বার্থে যাবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। দু’পক্ষের সওয়াল জবাবের পর বিচারক জানান, মঙ্গলবার এই নিয়ে রায় ঘোষণা করবে আদালত।
ইডির সওয়াল
চন্দ্রনাথকে সাত দিনের জন্য হেফাজতে চেয়ে ইডির আইনজীবী আদালতে জানান, ২০২৪ সালে তল্লাশি চালিয়ে চন্দ্রনাথের বাড়ি থেকে ৪১ লক্ষ টাকা এবং একটি মোবাইল উদ্ধার হয়েছিল। মন্ত্রী কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছিলেন, ওই টাকা কৃষিকাজ এবং জমি বিক্রির আয়। ইডির দাবি, মন্ত্রীর কাছে যে সমস্ত নথি আগে চাওয়া হয়েছিল সেগুলো ইচ্ছে করেই দেননি তিনি। চার্জশিট জমা পড়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই পাঠিয়ে দেন। চন্দ্রনাথকে প্রভাবশালী বলে দাবি করে ইডির বক্তব্য, ওই মন্ত্রী খুব প্রভাবশালী মানুষ। বার বার নোটিস পাঠিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায়নি, তা চন্দ্রনাথ এক দিনের মধ্যে দিয়ে দেন বলে জানিয়েছে ইডি। কেন এত দিন পরে চন্দ্রনাথকে হেফাজতে চাওয়া হচ্ছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ইডির আইনজীবী বলেন, “আমরা এত দিন ঘুমিয়ে ছিলাম না যে, আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওঁকে (চন্দ্রনাথ) হেফাজতে চাইব। ওঁর সম্পর্কে সব তথ্য জোগাড় না-করে গ্রেফতার করতে গেলে চন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সতর্ক হয়ে যেত। ওঁর বৃহত্তর যোগাযোগ রয়েছে। আমরা বাকি তথ্য পাইনি। এখন আমরা সব তথ্য জোগাড় করেছি, তাই হেফাজতে চাইছি।” চন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ইডির অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবশালী হয়ে উনি তদন্তকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন।
চন্দ্রনাথের আইনজীবীর সওয়াল
মন্ত্রীর আইনজীবী আদালতে সওয়াল করে বলেন, তদন্তের জন্য চন্দ্রনাথকে হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। চার্জশিট জমা দেওয়ার পরেও কেন ইডি পিছনে ফিরে ফের তদন্ত করতে চাইছে, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। চন্দ্রনাথের আইনজীবী বলেন, “ইডি বেশ কিছু তথ্য চেয়েছিল, যা কম সময় দেওয়া যায় না। এই তথ্য হাতের কাছে থাকে না।” বিচারক চন্দ্রনাথের আইনজীবীকে একটি নির্মাণ সংস্থার নাম করে প্রশ্ন করেন , আপনার মক্কেল কী ভাবে সেটির সঙ্গে যুক্ত? বিচারক বলেন, “ওই সংস্থার নামে জমি কিনে যৌথ ভাবে আবাসন বানানো হয়েছে। তা হলে ওই জমির দলিল তো কাছে থাকা উচিত। এর জন্য তো বিএলআরও-র কাছে যাওয়ার বা অনেক সময় নেওয়ার দরকার নেই।” একই সঙ্গে বিচারকের সংযোজন, ওঁর (চন্দ্রনাথের) স্ত্রী নিজের বয়ানে বলেছেন, কোনও রকম ব্যবসার কথা তিনি কিছু জানেন না। যা জানেন, উনি (চন্দ্রনাথ) জানেন। তা হলে সব কিছুর সঙ্গে অবহিত তিনি। তাহলে তো স্ত্রীর বয়ান অনুযায়ী উনি (চন্দ্রনাথ) সবটার সঙ্গে যুক্ত। আপনারা বলছেন প্যান, আধার ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্তু আপনাদের কেনা দলিল তো আপনার কাছে থাকা উচিত।” চন্দ্রনাথের আইনজীবী বলেন, “সন্দেহজনক নথি সম্পর্কে আমার মক্কেলের ব্যাখ্যা না-নিয়ে ইডি তাঁকে হেফাজতে চাইতে পারে না।” নতুন কী তথ্য ইডি পেয়েছে, আদালতে তা জানাতে বলেন চন্দ্রনাথের আইনজীবী।
ইডি রাজ্যের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নথি না-দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবারের শুনানিতে লিখিত জবাবে চন্দ্রনাথ আদালতকে জানান, গত ৭ অগস্ট ইডিকে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে। চন্দ্রনাথের আইনজীবীরা আদালতে জানান, প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তের সময় চন্দ্রনাথকে হেফাজতে নেওয়া হয়নি। তার মধ্যেই চার্জশিট জমা পড়েছে। রাজ্যের কারামন্ত্রীর তরফে আদালতে জানানো হয়েছে যে, জুলাই মাসে চন্দ্রনাথকে তলব করেছিল ইডি। সেই সময় তাঁর আইনজীবীরা গিয়েছিলেন। ৪ অগস্ট চন্দ্রনাথকে ফের ডাকা হলে তাঁর আইনজীবী তদন্তকারী আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করে জানাতে চেয়েছিলেন যে, ৭ অগস্ট সব নথি জমা করা হবে। কিন্তু সেই সময় তদন্তকারী আধিকারিক ছিলেন না বলে দাবি করা হয়েছে। চন্দ্রনাথের অভিযোগ, তার মধ্যেই গত ৬ অগস্ট চার্জশিট দিয়ে দেওয়া হয়। পাল্টা জবাব দেন ইডির আইনজীবীও। শনিবার চন্দ্রনাথের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী অয়ন ভট্টাচার্য। ইডির আইনজীবী ছিলেন ধীরজ ত্রিবেদী।
গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন চন্দ্রনাথ। ইডি তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু আদালত চন্দ্রনাথের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে। তবে কিছু শর্ত চাপিয়েছিল আদালত। জানিয়েছিল, জামিন পেলেও আপাতত নিজের বিধানসভা কেন্দ্র এবং কলকাতার বাইরে আর কোথাও যেতে পারবেন না মন্ত্রী। তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে তাঁকে। যত দিন এই সংক্রান্ত শুনানি শেষ না-হচ্ছে, তত দিন এই নিয়ম মানতে হবে।