প্রতীকী ছবি।
গরুর পালের পায়ের চাপে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া খেতের মধ্যে পড়েছিল নির্মল ঘোষের রক্তাক্ত দেহ।
নির্মল ছিলেন বিএসএফ জওয়ান। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর আংরাইল গ্রামে। আঁধার নামলেই যে গ্রামের মাঠ জুড়ে শুধু ছায়ামূর্তিদের দাপাদাপি। এ-পার থেকে অবাধে ও-পারে পাচার হত গরুর পাল। গরুর পায়ের চাপে ফলন্ত মাঠের দফারফা হতে দেখে মুখ খুলেছিলেন নির্মল। পাচারকারীদের গুলি ফুঁড়ে দিয়েছিল শরীর।
ঘটনাটা ২০১৫ সালের। নির্মলের খুনের পরে সশস্ত্র পাচারকারীদের হাতে প্রহৃত হন এলাকার এক শিক্ষক। প্রাণ যায় আরও এক ব্যক্তির। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, আংরাইলের নাম পৌঁছয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সদর দফতরে। ২০১৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ আংরাইলে আসেন। গরু পাচার বন্ধের নির্দেশ দেন। কয়েক মাসের মধ্যে বারাসতে প্রশাসনিক সভায় পাচার বন্ধের বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
আরও পড়ুন: গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে জোড়া পরীক্ষা মেট্রোর
আরও পড়ুন: উড়ালপুল বন্ধের প্রথম দিনে ভোগাল না যানজট
কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। সীমান্তের গ্রামে গ্রামে গরু পাচার তখন নিশ্চিত রুজির পথ। গ্রামের বহু মানুষ জড়িয়ে পড়েছিলেন পাচারের কাজে। কেউ গোয়াল ভাড়া দিতেন। কেউ বেনামে টাকা খাটাতেন গরুর ব্যবসায়। রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ও-পারে গরু পৌঁছে দিয়ে দু’-পাঁচ হাজার টাকা রোজগারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন গ্রামের বহু বেকার যুবকও।
তবে প্রশাসন চাইলে সীমান্ত দিয়ে মাছিও গলতে পারে না। বিএসএফ এবং পুলিশের তৎপরতায় ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বনগাঁ সীমান্তে কার্যত বন্ধ হয় পাইকারি হারে গরু পাচার।
তবে তখনও পাচার বন্ধ হয়নি স্বরূপনগর-সহ বসিরহাট মহকুমার কয়েকটি সীমান্ত এলাকায়। সন্ধ্যা নামলেই সীমান্তের ইছামতী-সোনাই-কালিন্দী-রায়মঙ্গল নদী দিয়ে পাচার হয়ে যেত গরু।
গত লোকসভা ভোটের আগে অবশ্য এই সব এলাকাতেও কড়াকড়ি বাড়ে। গরু পাচার বন্ধ হয় এখান দিয়েও। তবে চোরাগোপ্তা পাচার কখনওই বন্ধ হয়নি। করোনার দাপট এবং লকডাউনের পর থেকে অবশ্য পাচার অনেকটাই কমেছে বলে জানাচ্ছেন সীমান্তের বাসিন্দারা।
কী ভাবে হত পাচার? ভিন্ রাজ্য এবং এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লরিতে গরু এনে জড়ো করা হত সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে। রাত নামলেই খেতের ফসলের উপর দিয়ে সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হত গরু। সেখানেই হাতবদল হয়ে যেত। কাঁটাতারের উপরে বিশাল কাঠের পাটাতন বসানো হত। তাতে লুব্রিক্যান্ট ঢালা হত। ভ্যান থেকে সেই পাটাতনের উপরে গরুকে শুইয়ে তা তুলে ধরলেই চতুষ্পদ গড়গড়িয়ে ও পারে। নদী এলাকায় জল ঠেলেও গরু নিয়ে যাওয়া হত ও পারে।
বিএসএফের সঙ্গেও পাচারকারীদের ‘বোঝাপড়া’র কথা বার বার বলতেন গ্রামের মানুষ। ঘণ্টাখানেকের জন্য ‘লাইন’ (বর্ডার) খুলে দেওয়া হত বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। সে সময়ে পাল পাল গরু নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ত পাচারকারীরা। ও পার থেকে দুষ্কৃতীরাও আসত। সন্ধে নামতেই অস্ত্র নিয়ে তাদের দাপাদাপি কম দেখেননি সীমান্তের গ্রামের মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনায় গরু পাচার চক্রের কারবার পুরোটাই ছিল তারিক (নাম পরিবর্তিত) নামে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তার। বছরখানেক আগে প্রায় এক কোটি টাকার সোনা-সহ সল্টলেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেই সোনা সে বিএসএফের কোনও এক কর্তাকে ভেট দিতে নিয়ে যাচ্ছিল বলে জানতে পারে পুলিশ। বর্তমানে ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্ত হলেও সিবিআইয়ের নিশানায় সে রয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
খেতের ফসল নষ্ট হওয়া এবং পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য— এই দু’য়ের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে মানুষের প্রতিবাদ যে শেষ পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসনের কানে পৌঁছেছিল, তাতে সীমান্তের মানুষ এখন সন্তুষ্ট। এই কারণেই গরু পাচার কার্যত বন্ধ হয়েছে বলে বনগাঁ-বসিরহাটের মানুষ মনে করেন। উপরমহলের কর্তাদের সদিচ্ছা থাকলে পাচার বন্ধ যে সম্ভব, তা বহু বছর ধরেই বলে আসছিলেন তাঁরা।
তবে গরু পাচার বন্ধ হলেও পাচার অবশ্য চলছে অন্য নানা জিনিসের। কখনও সোনা, কখনও রুপো, নেশার ট্যাবলেট ইয়াবা, আবার মরসুমে ইলিশের পাচারও চলে। গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত অনেকে পেশা বদলে নিয়েছে বলেও জানা গেল। কেউ হয় তো গ্রামে এখন টোটো চালায়, কারও ছোট মুদির দোকান।
শুধু একটা বিষয় নিয়ে ধন্দ এখনও কাটেনি। বনগাঁর এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ‘‘ভিন্ রাজ্য থেকে শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সীমান্তে পৌঁছত গরু। জেলা সদর বারাসতের উপর দিয়ে দিনের বেলা গরু বোঝাই অসংখ্য ট্রাক আসত। গোটা পথের কোথাও কখনও কেন গরু আটকানো হত না, সে প্রশ্নের উত্তর আমরা আজও পাইনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy