কাঁচরাপাড়া থেকে পদযাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল ১১টায়। সন্ধ্যা ৭টায় সেই মিছিলের মাথা দেখা গেল ব্যারাকপুরে। ল্যাজ তখনও বহু দূরে! তার আগেই বি টি রোডের এক দিক স্তব্ধ করে দিয়ে বরানগর থেকে ব্যারাকপুর এসে পৌঁছেছে আরও একটি বিরাট মিছিল। আলিমুদ্দিন থেকে ব্যারাকপুর আসার পথে যার রেশ নিজের চোখেই দেখে নিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
রহস্যজনক কারণে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্যারাকপুরে ঘোষপাড়া রোডের উপরে রাস্তার বাতি সব নিষ্প্রভ! অন্ধকারের মধ্যেই অগুনতি কালো কালো মাথা এগিয়ে আসতে দেখে ব্যারাকপুর স্টেশন চত্বরের মঞ্চ থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘এত পরিশ্রম করছেন আপনারা। কর্মীরা এত পথ হাঁটছেন। এই লড়াই বৃথা যেতে দেবেন না!’’ আর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব উঠে আবেগবিহ্বল কণ্ঠে বললেন, ‘‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে! এই ভাবে এতটা রাস্তার জন্য পদযাত্রার কর্মসূচি নেওয়া উচিত হয়নি। অনেক কষ্ট দিলাম আপনাদের!’’
পদযাত্রীদের উৎসাহ দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েই অবশ্য নৈহাটিতে মিছিলকে স্বাগত জানাতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন গৌতমবাবু।
এই আবেগ এবং উৎসাহের অবশ্য সত্যিই কারণ ছিল বৃহস্পতিবার। মৃতপ্রায় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে প্রাণ সঞ্চারের দাবিতে এ দিনের জোড়া মহামিছিলের বহর চোখ কপালে তুলে দিয়েছে অনেকের! গত বছর পুরভোটে যে শিল্পাঞ্চলে বিরোধীরা কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি, শাসক দল একতরফা ভোট করেছে, সেখানে এত লোকের লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় বেরোনো বুদ্ধবাবুদের উৎসাহ বাড়িয়েছে বৈকি!
বস্তত, শুধু ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলই নয়, বিধানসভা ভোটের আগে রেশন কার্ড সমস্যাকে উপলক্ষ করে এ দিন গোটা রাজ্য জুড়েই সংগঠনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে নিয়েছে বামেরা। ব্যারাকপুরের মতোই বড় উদাহরণ বালি! কয়েক মাস আগে হাওড়া পুরনিগমের সঙ্গে বালি সংযুক্ত হওয়ার ভোটে কার্যত ময়দানেই দেখা যায়নি সিপিএমকে! এমনকী, ভোটের দিনও জোনাল কার্যালয়ে তালা দিয়ে ভিতরে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল বালির কয়েক জন নেতাকে। ইদানীং বালিতে যে কণিকা গঙ্গোপাধ্যায়দের খুঁজেই পাওয়া যেত না প্রায়, তাঁরাই এ দিন বেরিয়ে এসে রেশন-প্রশ্নে সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদে বালি পুরসভার সামনে সমাবেশ করেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বাম সমাবেশে হামলার অভিযোগও এসেছে। রায়নায় তৃণমূলের বোমায় স্বপন মালিক নামে এক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। পূর্ব মেদিনীপুরের সুনিয়া হয়ে রবীন দেব, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়দের মিছিল যাওয়ার সময়ে আশপাশ থেকে নাগাড়ে শূন্যে গুলি চলার অভিযোগ এসেছে! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘গুলি চললেও মিছিল কিন্তু বন্ধ হয়নি। স্বপন মালিকদের রক্তও বৃথা যাবে না!’’
সংগঠনকে চাঙ্গা করার পাশাপাশিই বেহাল শিল্প নিয়ে তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ উস্কে দেওয়ারও চেষ্টা চালিয়েছেন বুদ্ধবাবুরা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যেমন বলেছেন, ‘‘আমাদের সময়েও ব্যারাকপুরে কিছু কারখানা বন্ধ ছিল। কিছু কারখানা বাঁচানো যাবে না, আমরাও বুঝতাম। কিছু ক্ষেত্রে মালিকদের সমস্যা ছিল, ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে না শোধ দেওয়ার সমস্যা ছিল। কিন্তু কিছু চেষ্টা তো ছিল। এখন গোটা শিল্পাঞ্চলের কী অবস্থা? একটা কারখানার দরজা খুলেছে এই পাঁচ বছরে?’’ সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন তিনি।
আবার রেশন কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে এ দিন কলকাতা পুরসভার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে সূর্যবাবুর মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যেখানে হাত দেন, সেখানেই গোলমাল হয়! এ বার মুখ্যমন্ত্রী খাদ্যে হাত দিয়েছেন। সুতরাং, সব রেশন দোকান বন্ধ হবে!’’ ডিজিটাল রেশন কার্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে রেশন ডিলারদের কিছুই করার নেই জানিয়ে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে যেখানে মাথারা বসেন, সেখানে গিয়ে টেবিল উল্টে দিতে হবে! মানে বলতে হবে— এই ব্যবস্থা চলবে না!’’ তাঁর আরও আবেদন, ‘‘আপনাদের কার্ডে গন্ডগোল থাকলে তৃণমূল পার্টি অফিসে যেতে হবে না। বামফ্রন্টের লোকেরাও রাস্তায় থাকবে। তাঁদের হাতে কাগজ দেবেন। তাঁরাই ব্যবস্থা করে দেবেন।’’ শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘৪০ বছর বাদে রেশনে আবার ডিউ স্লিপ ফিরে এসেছে! মুখ্যমন্ত্রী খাদ্য সুরক্ষা দেওয়া নিয়ে কৃতিত্ব দাবি করতে গিয়ে সব গন্ডগোল করে দিয়েছেন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy