Advertisement
E-Paper

হামলা পুলিশের সামনেই

ছত্রভঙ্গ হয়ে মিছিল থেকে বেরিয়ে দলীয় কর্মীরা তখন পড়ি কি মরি করে ছুট লাগিয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ চেষ্টা করলেন পার্টি অফিসের ভিতরে ঢুকে পড়তে। পিছনে দলীয় পতাকা, ইট, লাঠি হাতে কয়েকশো তৃণমূল কর্মী। মুহূর্তে মারমুখী ওই জনতাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল সিপিএমের পার্টি অফিসে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু, হাত গুটিয়ে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১৫
রয়েছে পুলিশ। তার পরেও অস্ত্রশস্ত্র হাতে এলাকায় দাপাল তৃণমূলের কর্মীরা।

রয়েছে পুলিশ। তার পরেও অস্ত্রশস্ত্র হাতে এলাকায় দাপাল তৃণমূলের কর্মীরা।

ছত্রভঙ্গ হয়ে মিছিল থেকে বেরিয়ে দলীয় কর্মীরা তখন পড়ি কি মরি করে ছুট লাগিয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ চেষ্টা করলেন পার্টি অফিসের ভিতরে ঢুকে পড়তে। পিছনে দলীয় পতাকা, ইট, লাঠি হাতে কয়েকশো তৃণমূল কর্মী। মুহূর্তে মারমুখী ওই জনতাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল সিপিএমের পার্টি অফিসে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু, হাত গুটিয়ে।

বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ এই ছবিই দেখা গেল বীরভূমের মহম্মদবাজারে সিপিএম পার্টি অফিস লাগোয়া এলাকায়। দিনের শেষে ওই হামলায় সাঁইথিয়ার বিধায়ক ধীরেন বাগদি-সহ ১০ জন সিপিএম নেতা-কর্মী জখম হয়েছেন। বিধায়ককে বাঁচাতে গিয়ে হাত ভেঙেছে তাঁর দেহরক্ষীরও। তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের পাল্টা দাবি, পুলিশের বারণে দল এ দিন মিছিল বের করেনি। কিন্তু, সিপিএম মিছিল করায় দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা থানায় প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিলেন। তখনই সিপিএমের মিছিল ও পার্টি অফিস থেকে তাদের কর্মী-সমর্থকদের লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়া হয়।

ঠিক কী ঘটেছে এ দিন?

বন্‌ধের সমর্থনে এ দিন সকাল পৌনে ১০টা নাগাদ মহম্মদবাজারে মোরগ্রাম-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের বাসস্টপ থেকে মিছিল বের করেছিল সিপিএম। এলাকা অশান্ত হওয়ার আশঙ্কায় পুলিশ তাতে আপত্তি জানায়। পুলিশের বারণ মেনে এলাকা পরিক্রমা না করে দলীয় পার্টি অফিস পর্যন্ত মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম। ওই মিছিল দলের মহম্মদবাজার জোনাল অফিসের কাছে আসতেই বাঁশের লাঠি ও ইট-পাথর নিয়ে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। সিপিএমের কয়েক জন কর্মী-সমর্থকদেরও তখন ওই একই ইট-পাথর তুলে নিয়ে তৃণমূলের দিকে ছুড়তে দেখা যায়। তবে, তৃণমূল দলে ভারী হওয়ায় সিপিএমের সেই প্রতিরোধ বেশি ক্ষণ টেকেনি।

তত ক্ষণে সিপিএমের মিছিল পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দলীয় অফিসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ইট-পাথর বৃষ্টির মধ্যেই ধীরেনবাবু, সিপিএমের জোনাল সম্পাদক প্রভাস মাল, জোনাল সদস্য শ্রীজিৎ মুখোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য নেতৃত্ব দলীয় কর্মীদের গার্ড করে পার্টি অফিসে ঢোকানোর চেষ্টা করেন। ঠিক ওই সময়ই একটি আধলা ইট এসে পড়ে শ্রীজিৎবাবুর মাথায়। মাথা ফেটে গড় গড় করে রক্ত ঝরতে থাকে। ওই সময় পুলিশের সামনেই তৃণমূল কর্মীরা ধীরেনবাবুকে ঘিরে ধরে। লাঠি দিয়ে তাঁকে মারধর করা হয়। বিধায়ককে বাঁচাতে গিয়ে হাতে লাঠির ঘা খান তাঁর নিরাপত্তারক্ষী পরেশ হাঁসদা। মাটিতে ফেলে মারধর করা হয় সিপিএম কর্মী বৈদ্যনাথ মিশ্র, লক্ষ্মীরাম কিস্কুদেরও। ওই ঘটনায় এ দিনই মহম্মদবাজার থানায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ দায়ের করেছে সিপিএম।

“ব্যারিকেড খুলে তৃণমূলের লোকজনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
ওদের সামনেই তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী আমাদের উপর রড, লাঠি, ইট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।” — ধীরেন বাগদি।

“সিপিএম নাটক করছে। সিপিএমের অফিস থেকেই ঢিল ছোড়া হয়।
আমাদের কেউ হামলা চালায়নি।” —অনুব্রত মণ্ডল।

এ দিকে, জখম সিপিএম কর্মীদের প্রথমে পটেলনগরে মহম্মদবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শ্রীজিৎবাবুর মাথায় আটটি সেলাই পড়েছে। তাঁকে এবং বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও বিধায়কের নিরাপত্তা রক্ষী-সহ ঘটনায় জখম পাঁচ সিপিএম কর্মীকে সিউড়ি সদর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। জোনাল সম্পাদক প্রভাসবাবুর দাবি, জখমদের মধ্যে দলের দুই মহিলা সমর্থকও আছেন। গোটা ঘটনাটি তৃণমূল ব্লক সভাপতি তাপস সিংহ, অঞ্চল সভাপতি অলোক ভট্টাচার্য এবং স্থানীয় নেতা বুবাই সরকারের নেতৃত্বে হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। ঘটনায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।

ধীরেনবাবুর বক্তব্য, পুলিশের বারণ মেনে তাঁরা কর্মসূচি ছেঁটে পার্টি অফিস পর্যন্ত মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেন। পথে তৃণমূলের পার্টি অফিস পার হতেই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা সিপিএমের মিছিলের পিছু নেয়। বিধায়কের দাবি, ‘‘পুলিশ তৃণমূলের ওই সশস্ত্র বাহিনীকে প্রথমে ব্যারিকেড করে আটকায়। পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পুলিশ আমাদের পার্টি অফিসে চলে যেতে বলে। আমাদের কর্মীরা যখন পার্টি অফিসে ঢুকতে শুরু করেছে, সেই সময়ই ব্যারিকেড খুলে তৃণমূলের লোকজনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ওদের সামনেই তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী আমাদের উপর রড, লাঠি, ইট-পাথর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’’

ঘটনা হল, বন্‌ধকে কেন্দ্র করে সিপিএম ও তৃণমূলের মিছিল পাল্টা মিছিল থেকে গণ্ডগোল যে বাধতে পারে, তা পুলিশ আগে থেকেই আঁচ করেছিল। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে দু’লের কাছেই এ দিন মিছিল বের না করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু, পুলিশের নিষেধ অমান্য করে সকাল থেকে দু’ দলেরই কর্মী-সমর্থকেরা কাঁইজুলি বাসস্টপের কাছে, ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর জড়ো হতে শুরু করে। সেখান থেকেই উত্তেজনার শুরু।

পুলিশের দাবি, প্রথমে সিপিএমের মিছিল থেকে তৃণমূল কর্মীদের উদ্দেশ্যে উস্কানি দেওয়া হয়েছিল। তার পরেই দু’পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাত বাধে। তখনকার মতো বিরোধ সামলে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদেরকে দলীয় কার্যালয়ে ঢুকিয়ে দেয় উপস্থিত পুলিশকর্মীরা। এরপরে আরও লোক জড়ো করে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায় তৃণমূল। ওই হামলা হতে পারে, পুলিশ তা অনুমান করতে পারেনি বলেই দাবি। কতকটা পুলিশের সুরেই ঘটনায় দায় সিপিএমের ঘাড়ে চাপিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বও।

দলের যুগ্ম ব্লক সভাপতি তাপস সিংহের বক্তব্য, ‘‘আমরা জড়ো হয়ে গেলেও পুলিশ মিছিল করতে বারণ করায় তা বাতিল করি। কিন্তু, সিপিএম মিছিল করে। আমাদের কিছু কর্মী তারই প্রতিবাদ জানাতে থানায় যাচ্ছিলেন। তখনই তাঁদের লক্ষ্য করে সিপিএমের পার্টি অফিসের ছাদ থেকে ইট-পাথর ছোড়া হয়।’’ তাঁর দাবি, আত্মরক্ষায় আমাদের কর্মীদের একাংশ পাল্টা ঢিল ছুড়ে থাকতে পারে। তার বেশি কিছু হয়নি। অন্য দিকে, ঘটনার পরে নিজের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে দেখিয়ে অলোকবাবু অভিযোগ করেন, ‘‘ওরা আধলা ইট মেরে আমার হাত ফাটিয়ে দিয়েছে। আমাদের মোট ২০ জন কর্মী আহত হয়েছেন।’’ সিপিএমের পরে তৃণমূলও ওই ঘটনায় থানায় পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছে।

এ দিনই আবার বন্‌ধকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায় সাঁইথিয়া ও সংলগ্ন এলাকাতেও। সাঁইথিয়া-সহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায় তৃণমূলের সশস্ত্র বাইক বাহিনীকে। ৪০-৫০ জনের ওই বাইক বাহিনীর হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, লাঠি ও পেটো ভর্তি ছোট ছোট ড্রাম। আবার উল্টো ছবি দেখা যায় সাঁইথিয়ার সাকিড়াপাড় গ্রামে। সেখানে একটি কোল্ডস্টোরেজ খোলার জন্য তৃণমূল কর্মীরা গেলে দু’পক্ষের মধ্যে বোমাবাজি হয়।

সন্ধ্যায় জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার জানান, এ দিন কোনও ঘটনাতেই কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে, পুলিশকে এ দিন কেন কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা গেল, তার সদুত্তর এসপি-র কাছে মেলেনি। অন্য দিকে, স্থানীয় নেতাদের সুরেই সুর মিলিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। তাঁর দাবি, ‘‘সিপিএম নাটক করছে। সিপিএমের অফিস থেকেই ঢিল ছোড়া হয়। আমাদের কেউ কোনও হামলা চালায়নি।’’ এ দিনই ঘটনার পরে মহম্মদবাজারে এসে অনুব্রতর বক্তব্যের বিরোধিতা করে প্রাক্তন জেলা সম্পাদক তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম পাল্টা বলেন, ‘‘তৃণমূল প্রলাপ বকছে। আসলে ওদের পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তাই ন্যায্য দাবিতে ডাকা বন্‌ধে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিতে দেখে ওরা নিজেদের মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।’’

বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

CPM Trinamool strike left front
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy