Advertisement
E-Paper

বিধি বাম, রুখে দাঁড়ানোর হুঙ্কারই সার

সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সর্বস্তরে প্রতিরোধের কথা বলেছিলেন দলের অন্য নেতারাও। প্রার্থীরা আবার কোথাও কোথাও এক ধাপ এগিয়ে মাটি কামড়ে বুথরক্ষার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, বুথ কব্জা করেই জিততে চাইছে শাসক দল। তাই বামেদের স্বেচ্ছাসেবকেরা এ বার শুধুই ভোটারদের বুথে নিয়ে আসা আর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মতো ‘নিরামিষ’ কাজ আর করবেন না। সিপিএমের দলীয় মুখপত্রেও শনিবার ফলাও করে হেডলাইন হয়েছিল, ‘ভোট লুটের চেষ্টা হলেই প্রতিরোধ’।

নিজস্ব সংবদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০২:১৬
পুলিশি নিরাপত্তায় উত্তর কলকাতার একটি বুথে ঢুকছেন সিপিএম নেতা সুধাংশু শীল। ছবি: সুমন বল্লভ।

পুলিশি নিরাপত্তায় উত্তর কলকাতার একটি বুথে ঢুকছেন সিপিএম নেতা সুধাংশু শীল। ছবি: সুমন বল্লভ।

সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সর্বস্তরে প্রতিরোধের কথা বলেছিলেন দলের অন্য নেতারাও। প্রার্থীরা আবার কোথাও কোথাও এক ধাপ এগিয়ে মাটি কামড়ে বুথরক্ষার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, বুথ কব্জা করেই জিততে চাইছে শাসক দল। তাই বামেদের স্বেচ্ছাসেবকেরা এ বার শুধুই ভোটারদের বুথে নিয়ে আসা আর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মতো ‘নিরামিষ’ কাজ আর করবেন না। সিপিএমের দলীয় মুখপত্রেও শনিবার ফলাও করে হেডলাইন হয়েছিল, ‘ভোট লুটের চেষ্টা হলেই প্রতিরোধ’।
বাস্তবে কী হল?
পুরভোটের দিন প্রায় দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হল বামেদের। বুথে বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া তো দূর অস্ত্, বেশির ভাগ জায়গায় বুথ ক্যাম্পই করে উঠতে পারলেন না তাঁরা!
তৃণমূলকে ময়দান ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ মানতে চাননি সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। বিশাখাপত্তনমে বসে দিনভর কলকাতার খবর নিতে নিতে সূর্যবাবুর মন্তব্য, ‘‘দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী আমাদের ৭৫ জন মার খেয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা শতাধিক। এঁরা ময়দানে ছিলেন বলেই ওঁদের উপরে এই আক্রমণ হয়েছে।’’ কলকাতায় সিপিএম নেতা রবীন দেবও বলেন, ‘‘আমরা যা বলেছিলাম, তা করার চেষ্টা করেছি। মার খেয়েও বামপন্থী ভোটকর্মীরা বুথ বা রাস্তা ছেড়ে যাননি। তাঁদের অভিনন্দন জানাই।’’
তবে শাসক দলের সঙ্গে ধারে-ভারে কিছুতেই যে তাঁরা এঁটে উঠতে পারেননি, তা কবুল করেছেন বাম নেতারা। ‘ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে’ বলে অভিযোগ করে সূর্যবাবুর মন্তব্য, ‘‘একটা অসম লড়াই হচ্ছে। শাসক দল, তার গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পুলিশ দুষ্কৃতীদের ধরার বদলে তাদের মদত দিচ্ছে! আর রাজ্য নির্বাচন কমিশন তাদের অসহায়তা জানিয়ে দিয়েছে।’’
ভোট-পর্ব মিটে যাওয়ার পরে এ দিনই জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসে রাজ্য বামফ্রন্ট। রবীনবাবু জানান, সন্ত্রাস ও ভোট লুঠের প্রতিবাদে আজ, রবিবার রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে। কাল, সোমবার লালবাজার অভিযান। রবীনবাবু বলেন, ‘‘আমরা বহু বুথে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছি। আরও ৯১টি পুরসভায় ভোট আছে। যদি নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে আমরা বাংলা বন্‌ধ ডাকতে বাধ্য হব।’’
খাস কলকাতায় বামেদের সংগঠন কোনও কালেই খুব আহামরি নয়। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই দু’-দু’বার কলকাতা পুরসভায় ক্ষমতা খুইয়েছে তারা। বিদায়ী পুরসভায় ১৫টি বরোর মধ্যে একটি মাত্র বরো বামেদের দখলে ছিল। তারা তিন নম্বর বরোর ন’টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসন দখলে রাখতে পেরেছিল। এ দিন ওই বরোতেই একটি-দু’টি আসন ছাড়া কোথাওই বামেদের কার্যত খুঁজে পাওয়া গেল না। বাম আমলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুরপিতা রাজীব বিশ্বাস এ বারও প্রার্থী ছিলেন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু তিনিও সব বুথে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেননি! যে ক’টা বুথে পেরেছিলেন, সেখান থেকেও এজেন্ট তুলে নিতে হল বেলা বারোটা বাজতে না বাজতেই! হতাশ রাজীববাবুর মন্তব্য, ‘‘এ এক অদ্ভুত প্রহসন চলছে!’’ সব দেখে কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন, শহরে বামেদের সংগঠন যেটুকুও বা ছিল, ২০১১-র পর থেকে তা আরও ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। সংগঠনে অবিলম্বে শান না দিলে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে শাসক দলের সঙ্গে টক্কর দেওয়া অসম্ভব।
সিপিএমের পক্ষ থেকে কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছিল গড়িয়া, যাদবপুর, সন্তোষপুর, মুকুন্দপুর এলাকায়। কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে, সেখানেও সিপিএম রণে ভঙ্গ দিয়েছে। নিজের এলাকায় শাসক দলের হাতে হেনস্থা হতে হয় কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে। এক যুবকের হাতে সপাটে গালে চড় খেয়ে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে হয়েছে গড়িয়া দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজ লাগোয়া এলাকার এক সময়কার দাপুটে নেতা উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কে। কাশীপুর, বেলগাছিয়া, বেলেঘাটা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, গার্ডেনরিচ এলাকার অন্তত ৩০টি ওয়ার্ডের প্রায় সব বুথই দখল হয়ে গিয়েছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। ওই বুথগুলির বেশির ভাগেই গত লোকসভা ভোটে সামান্য হলেও এগিয়ে ছিল বামেরা।
গোটা শহরে অন্তত দু’হাজার বুথে ভোট লুঠ হয়েছে বলে অভিযোগ আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্যের। রবীনবাবুর বক্তব্য, এত বুথ দখল হয়েছে যে, এখনও সব হিসেবই করে ওঠা যায়নি! তাঁদের দাবি, শাসক দল যে ভাবে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের দিয়ে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তার সামনে দাঁড়াতে পারেননি বাম কর্মীরা। কিন্তু ভোটের আগে তো রবীনবাবুরা বলেছিলেন, সন্ত্রাস করতে এলে কেউ ফিরে যাবেন না। বাম কর্মীরা তাদের আটকে রাখবেন। এ দিন রবীনবাবুর মন্তব্য, ‘‘এটা করা যায়নি ঠিকই। কিন্তু মহিলারা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। এটাই বড় সাফল্য।’’
বামফ্রন্টের একাংশের নেতাদের অবশ্য বক্তব্য, এ সব বলে লাভ নেই। সিপিএমের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘অতীতে এর থেকে বেশি সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছে দল। কিন্তু তখন নেতারা রাস্তায় নেমে মার খেতেন। তাতে কর্মীদের মনোবল বাড়ত। আর সাধারণ মানুষের সমর্থনও আমাদের সঙ্গে ছিল। এখন দু’টোর কোনওটাই নেই। তাই মুখে প্রতিরোধ বললেও বাস্তবে তা বারবার ব্যর্থই হচ্ছে।’’ বিমান বসুদের অবশ্য আক্ষেপ, পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে কলকাতার পুরভোটের দিন মিলে না গেলে আক্রান্ত কর্মীদের পাশে তাঁরাও রাস্তায় থাকতে পারতেন।
আগামী শনিবার রাজ্য জুড়ে ৯১টি পুরসভার ভোট। কলকাতায় ‘মার’ খাওয়ার পরে সেখানে বামেরা কতটা রুখে দাঁড়াতে পারবে, তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে। সূর্যবাবুর দাবি, ‘‘বাকি ৯১টা পুরসভায় তৃণমূলকে আরও বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে! আমাদেরও আরও বেশি তৈরি থাকতে হবে।’’
তবে এ দিনের পরে বামেদের নতুন কৌশল, এখন থেকে সব কর্মসূচি আর জানিয়ে করা হবে না। কে কোথায় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা আগাম জানাজানি হয়ে যাওয়ায় হামলা চালিয়ে মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে— কান্তিবাবুর উপরে আক্রমণেই এটা স্পষ্ট বলে মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘সবটা ঘোষণা করে দিয়ে আর কাজ হবে না! যখন হবে, তখনই জানা যাবে।’’ দলের অন্দরে পুরনো এই ‘গেরিলা’ কায়দার পক্ষেই সওয়াল করতেন কান্তিবাবুরা।
নয়া কৌশলে রাজ্যের অন্যত্র বামেরা মাথা তুলতে পারবে কি না, সাত দিন পরে তারই পরীক্ষা।

CPM KMC BJP municipal election suryakanta misra mamata banerjee election commission
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy