বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) পরে রাজ্যে ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের নাম। কারণ, তাঁদের অনেকেই ২০০২ সালের পরে এই দেশে এসেছেন এবং ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় (এসআইআর-এ ভিত্তি-বর্ষ ধরা হয়েছে যাকে) নাম ছিল না। এসআইআর-এ গ্রাহ্য হওয়ার মতো অন্য কোনও নথিও তাঁদের অনেকেরই হাতে নেই। এমতাবস্থায় রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে মতুয়াদের নাম ভোটার তালিকায় রাখতে তৎপর হয়েছে সব রাজনৈতিক দল। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরে সোমবার সেই লক্ষ্যেই চলল দিনভর দরবার।
রাজ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি নির্বাচনে মতুয়া-গড়ে ভাল ফল করেছে বিজেপি। এসআইআর-এর সময়ে মতুয়াদের বড় অংশ নথি নিয়ে বিপাকে পড়তে পারেন বুঝে বিজেপি সেই সব এলাকায় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে (সিএএ) আবেদন করার শিবির চালিয়েছে। কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকে এসআইআর-এর জন্য গ্রাহ্য নথি হিসেবে ধরার সংস্থান কমিশনের নিয়মাবলিতে নেই। এর ফলে খসড়া তালিতা থেকে নাম বাদ যাওয়ার আশঙ্কা করছেন মতুয়াদের একাংশ। ‘বিপদ’ বুঝে বিজেপি এখন চেষ্টা করছে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মতুয়াদের নাম তালিকায় ঢোকাতে। এই প্রেক্ষিতেই এ দিন সিইও-র দফতরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে ৪৫ জন বিধায়ক দাবিপত্র দিতে গিয়েছিলেন। ছিলেন বিজেপির তরফে নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত শিশির বাজোরিয়া, রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, সহ-সভাপতি সঞ্জয় সিংহ প্রমুখ।
সূত্রের খবর, কমিশনের কাছে বিজেপির তরফে দাবি করা হয়েছে, নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। প্রতি দিন শতাধিক মানুষ আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। তাই তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হোক। জগন্নাথ বলেন, ‘‘আমাদের দাবি, যে হিন্দু শরণার্থীরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত ২০০২ সালের পরে ভারতে এসেছেন, তাঁদের নাম খসড়া তালিকায় নাও থাকতে পারে। কিন্তু ইতিমধ্যে যাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছেন, তাঁদের শুনানির সময়ে ভোটার তালিকায় নাম তুলে দেওয়া হোক। যাঁরা আবেদন করে রেখেছেন, কিন্তু তখনও নাগরিকত্ব পাবেন না, শুনানির পরে তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হোক।’’
মতুয়াদের একটি অংশ এ দিনই কলেজ স্ট্রিট থেকে মিছিল করে সিইও দফতরে গিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী, সুমন পাল, সৌম্য আইচ রায়েরা। কমিশনের কাছে অধীরের দাবি, নাগরিকত্বের প্রশ্ন বকেয়া থাকাকালীন মতুয়াদের নাম যেন ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া না হয়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস, দু’দলই মতুয়াদের ভোট নিয়ে জিতেছে। তার পরে কিছু করেনি। মতুয়াদের এখন অন্তত এসআইআর থেকে মুক্ত রাখা হোক। সংসদের অধিবেশনে বিশেষ অধ্যাদেশ আনুক কেন্দ্রীয় সরকার।’’ একই দিনে প্রদেশ কংগ্রেসের তরফে অমিতাভ চক্রবর্তী, প্রশান্ত দত্ত, আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়েরা এসআইআর-এর বিশেষ তালিকা পর্যবেক্ষক সুব্রত গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে মতুয়াদের সমস্যার কথা তুলেছেন। অমিতাভের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে মতুয়ারা এসেছেন, তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না। তার মানে তাঁরা অনুপ্রবেশকারী নন বলে সরকারি ভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে। খসড়া তালিকা নিয়ে শুনানিতে তাঁদের সুযোগ দেওয়া হোক।’’
এর পরে আবার তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘে’র তরফে মিছিল করে গিয়ে সিইও দফতরে দাবিপত্র দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে যে সব মতুয়া, উদ্বাস্তু, নমঃশূদ্র মানুষের নাম ভোটার তালিকায় ছিল, তাঁদের বাদ দেওয়া যাবে না। দিল্লিতে সংসদের কাজে ব্যস্ত থাকায় মমতা নিজে অবশ্য কর্মসূচিতে ছিলেন না। মহাসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সুকেশ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘‘বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা থেকে জানতে পারছি, প্রায় দেড় কোটি মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। এর ফলে মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের কাছে খুবই সামান্য বা কোনও নথিপত্রই নেই। কমিশনকে আমাদের দাবিপত্র দিয়েছি। সমস্যা না-মিটলে আমাদের অনশন কর্মসূচি পুনরায় শুরু করা হবে।’’ আর সাংসদ মমতার বক্তব্য, ‘‘বনগাঁ মহকুমা থেকেই মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষদের নাম সব চেয়ে বেশি বাদ যাবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। মোট বাদ যাওয়া ভোটারের মধ্যে প্রায় ৫০% মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষ হবেন। সে কারণেই আমরা আন্দোলন শুরু করেছি।’’
তবে গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক তথা বিজেপি প্রভাবিত ‘অল মতুয়া মহাসঙ্ঘের’ সঙ্ঘাধিপতি সুব্রত ঠাকুরের মতে, ‘‘রাজ্যে ২৩ বছর পরে এসআইআর হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে অনেকে মারা গিয়েছেন, স্থানান্তরিত হয়েছে। বিবাহ বা কর্মসূত্রে অনেকে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। বাংলাদেশি মুসলিম ও রোহিঙ্গারা নাম তুলেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের নাম বাদ যাবে। মতুয়াদের উদ্বেগের কিছু নেই।’’ তিনি ফের দাবি করেছেন, ‘‘সিএএ রক্ষাকবচের মাধ্যমে তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন এবং এসআইআর প্রক্রিয়ায় নাম উঠবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)