Advertisement
E-Paper

‘বাঁচলাম যখন, বাঁচার মতো বাঁচব’

২০১৩ সালে দুর্গাপুজোর দশমীর রাতে শহর যখন ভাসানে ব্যস্ত, তাঁর জীবনের একটা পর্বের ভাসান কার্যত সে দিনই হয়ে গিয়েছিল।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০৪:০৮
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত অবস্থায় সুপর্ণা। নিজস্ব চিত্র

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত অবস্থায় সুপর্ণা। নিজস্ব চিত্র

এটা ম্যাজিক নয়। রূপকথাও নয়। জীবন অত সহজ ছকে চলে না।’’

কথোপকথনের শুরুতে স্বগতোক্তি করেছিলেন এই মেয়ে।

মেয়েটির জীবন বলছে, বই কেনার টাকা ছিল না। সহপাঠীদের থেকে বই চাইলে অনেকের কাছেই শুনতে হত, ‘যখন এতই সমস্যা, ডাক্তারি পড়তে এলি কেন?’

হস্টেলে তাঁর সঙ্গে এক ঘরে থাকতে রাজি হতেন না কেউ। কারণ, তাঁর সঙ্গে বাকিদের নাকি ‘ঠিক মেলে না’।

দিনের পর দিন আদালত চত্বরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হত তাঁকে। নিয়মিত ক্লাস করা হত না।

এত কিছুর পরেও ৩৬ বছর বয়সে এমবিবিএস পাশ করে আপাতত বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের হাউসস্টাফ সুপর্ণা গোস্বামী। ডিউটি সামলে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। যে চিকিৎসকেরা কৈখালির বাসিন্দা সুপর্ণার এই লড়াইয়ের গল্প জানেন, তাঁদের অনেকেই এখন ক্লাসে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন মেয়েটিকে— বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার ১২ বছর পরে যিনি আবার জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেছিলেন।

২০১৩ সালে দুর্গাপুজোর দশমীর রাতে শহর যখন ভাসানে ব্যস্ত, তাঁর জীবনের একটা পর্বের ভাসান কার্যত সে দিনই হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে এক বস্ত্রে বিতাড়িত হওয়ার পর, শিয়ালদহ স্টেশনে একা রাত কাটানোর আগে নিজের জীবনটাই শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সহযাত্রীদের চেষ্টায় কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন আর সেই রাতটা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ‘তোমার দ্বারা বিশেষ কিছু হবে না’— কথাটা বার বার বলেআশপাশের মানুষেরা যাঁকে থমকে দিতে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন, সেই মেয়েই ঠিক করে ফেলেন, সব কিছুর শেষ দেখে ছাড়বেন। ‘‘এটাকে তপস্যাও বলতে পারেন। আমার তো মরে যাওয়ারই কথা ছিল। বাঁচলাম যখন, ঠিক করলাম, বাঁচার মতো করে বাঁচব।’’ বললেন সুপর্ণা।

সুপর্ণার দায়ের করা বধূ নির্যাতনের মামলা আপাতত ঝুলে রয়েছে। গর্ভের সন্তান দু’-দু’বার নষ্ট হয়েছে। প্রথম বার ‘রাপচারড এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি’। দ্বিতীয় বারও গর্ভপাত হয়ে যায়। সেই পরিস্থিতি থেকেও তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যে কোনও মানুষকেই শক্তি জোগাবে বলে মনে করছেন চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ।

গোড়ায় হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজে পড়তেন সুপর্ণা। সম্বন্ধ করে ২০০৮ সালে বিয়ে হয়। বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই সমস্যা। পড়াশোনা, চাকরি, বাধা আসতে থাকে সব বিষয়েই। ২০১০ সালে ‘রাপচারড প্রেগন্যান্সি’। অভিযোগ, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পরে দ্বিতীয় বারও গর্ভপাত হয় তাঁর। সুপর্ণার অভিযোগ, ‘‘সব দিক থেকে যখন বিধ্বস্ত, তখনই স্বামীর দ্বিতীয় সম্পর্কের কথা জানতে পারি। জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তখন আমি জয়েন্ট দিয়ে এমবিবিএস পড়তে শুরু করেছি। হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে স্বামীর সম্পর্কটা আরও খোলাখুলি দেখতে পাই। প্রতিবাদ করায় আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয়। যৌথ ভাবে কেনা ফ্ল্যাট, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট সবই তত ক্ষণে চলে গিয়েছে।’’

সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়ের বিবাহিত জীবনে সমস্যার কথা জানলে ‘মানিয়ে নেওয়া’র জন্য যখন জোর করা হয়, সুপর্ণার জীবনের গল্পটা কিছুটা আলাদা। আশপাশের বেশিরভাগ মানুষ ‘মানিয়েগুছিয়ে’ থাকার পরামর্শ দিলেও নিজের মতো করে বাঁচতে বলেছিলেন সুপর্ণার বাবা, মা ও ভাই। বাবা অরুণ গোস্বামী ও মা সুতপা মেয়েকে বলেছিলেন, ‘‘জীবন যে ভাবে হোক চলে যাবে। কিন্তু অন্যায়টা মেনে নিস না।’’
তার পর? সুপর্ণা জানান, তাঁর রেলকর্মী বাবার ১৫ হাজার টাকার পেনশনে সংসার চলে। আর সেই পেনশনের বেশিরভাগটাই খরচ হয়ে যায় মেয়ের লেখাপড়ার খাতে। সঙ্গে মামলা চালানো আর চিকিৎসার খরচ। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি, সকলেরই সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। উত্তর আসেনি। তাঁর কথায়, ‘‘গত পাঁচ-ছ’বছর আমার বাবা-মা সেদ্ধ ভাত খেয়ে কাটাচ্ছে। ছুটিতে বাড়ি এসে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তেল সহ্য হয় না। আমি তো জানি, ওদের খাবারের তালিকাটা সংক্ষিপ্ত হতে হতে প্রায় শেষ হতে বসেছে, আমারই জন্য। পাঁচ বছরে একটা নতুন জামা কেনেনি ওরা।’’ অরুণবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমরা তো বিশেষ কিছুই করতে পারিনি। শুধু ওকে বলেছিলাম, পাশে আছি। ওকে একা হতে দিইনি।’’

প্রথম বার জয়েন্ট এন্ট্রান্সে উত্তীর্ণ হতে পারেননি সুপর্ণা, প্রস্তুতিই তো নিতে পারেননি। তবে হাল ছাড়েননি। বললেন, ‘‘এতগুলো বছর নষ্ট হয়েছে। আরও একটা বছর না হয় নষ্ট হল। মনের জোরটা হারাইনি। পরের বার সফল হলাম।’’ এমবিবিএস কেন? ‘‘আমি স্ত্রী রোগ নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই।’’

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে শুরু হয় নতুন জীবনের যাত্রা। সেখানেও পর পর বাধা। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। পড়ার জন্য টাকার জোগাড়ও করেছিলেন তাঁদের অনেকে। হস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট শোনাচ্ছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘ওর সঙ্গে কেউ থাকতে চাইত না। বলত, ওর সঙ্গে টোন-এ মেলে না। মেয়েটা দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছে। বেশি বয়সে পড়তে আসা নিয়ে অনেকের মনেই ওর সম্পর্কে কৌতূহল, ব্যঙ্গ ছিল। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ওকে সিঙ্গল রুম দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আমাদের মনে হয়েছিল, সব লড়াইটাই তো ও একা লড়ছে, আমরা না হয় ওর দৈনন্দিন বেঁচে থাকাটাকে একটু সহজ করার চেষ্টা করি।’’

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, হাইপোথাইরয়েডিজম এবং অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণে ঋতুকালীন অস্বাভাবিক রক্তপাতের সমস্যায় ভোগা মেয়েটিকে ডাক্তাররা নিয়মিত বেশ কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে বলেছিলেন। টাকার অভাবে সে সব বন্ধ হয়ে যায়। ‘‘ওষুধ কেনার

জন্য ২০০ টাকাও জোগাড় করতে পারিনি। সেকেন্ড প্রফেশনাল এমবিবিএস পরীক্ষা পুরোটই মেনোরাজিয়া নিয়ে দিয়েছিলাম।’’ অবলীলায় সুপর্ণা যখন এ সব বলে যান, তখন সার্জারি বিভাগের

শিক্ষক-চিকিৎসক নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘ও সব পারবে। ওর যা মনের জোর, ও কোথাও থেমে থাকবে না।’’ প্যাথোলজির শিক্ষক-চিকিৎসক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মেয়েটি তখন আর্থিক, সামাজিক, মানসিক ও আইনগত সমস্যায় জর্জরিত ছিল। বয়স বেশি বলে ক্লাসেও সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্কে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। আমরা, শিক্ষকেরা প্রধানত ওর মানসিক স্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। মেয়েটি অসম্ভব সৎ, পরিশ্রমী ও পড়াশোনায় একনিষ্ঠ।’’

আর সুপর্ণা বলেন, ‘‘বয়স আমার স্বপ্নগুলোকে অনেকটা দূরে ঠেলে দিয়েছে। ৩৬ বছর বয়সে আমি জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারের চাকরি পাব না। সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেতে গেলে আমাকে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করতেই হবে। যে ভাবেই হোক, চালিয়ে যাব। কারণ, সেখানেই সাধারণ মানুষের সেবা করার সুযোগটা রয়েছে।’’

ম্যাজিক নয়।

রূপকথাও নয়।

বাঁচলেন যখন, বাঁচার মতো করেই বাঁচছেন। সুপর্ণা!

Suparna Goswami Burdwan Medical College
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy