সবে মিলি...। রায়দিঘির নগেন্দ্রপুর অঞ্চলে দমকল মণ্ডলপাড়া গ্রামের পুজো মণ্ডপে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
স্থায়ী পুজো মণ্ডপে প্রতিমা গড়ার কাজ প্রায় শেষ। শুধু রং বাকি। সেখানে বসেই দুপুরে পুজোর মিটিং করছিলেন জনা দশেক গ্রামবাসী। কতগুলো ঘর থেকে চাঁদা তোলা বাকি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কী বৈচিত্র্য আনা যায়— এ সব আলোচনা আর প্রতিমা কী রকম হল, সরেজমিনে দেখা। ওঁরা সবাই পুজো কমিটির সদস্য। শ্যামল খাঁ, বিমল খাঁ, সুব্রত মণ্ডল, রশিদ বৈদ্য, ইয়াসিন গাজি। ছোট ফ্লেক্স-এ লেখা নগেন্দ্রপুর অঞ্চল সর্বজনীন দুর্গোৎসব। আসলে সর্বধর্ম সমন্বয়ের উৎসব। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শারদোৎসব। দেশের ইতিউতি ঠেলে বেরোনো বিদ্বেষ, অসিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বড় বিজ্ঞাপন। এ বার ৪০ বছর পূর্তি।
কলকাতা থেকে দক্ষিণে দেড়শো কিলোমিটার দূরে, সুন্দরবনের জটা দ্বীপের দমকল মণ্ডলপাড়া নামে অজগাঁয়ের এই পুজোয় সর্বজনীন শব্দটার অর্থ যেন সত্যিই ফুটে বেরোয়। পূর্বে ঠাকুরাণ আর পশ্চিমে মণি নদীর পাড় সন্নিহিত অঞ্চলে এই পুজো প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। পুজোর চাঁদা তোলেন ও দেন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান এবং পুজো ও সেই উপলক্ষে হওয়া উৎসবেও যোগ দেন খান কুড়ি গ্রামের বাসিন্দা প্রায় বিশ হাজার লোক। নানা ধর্ম, নানা সম্প্রদায়ের। রায়দিঘি এলাকার অন্তর্গত এই অঞ্চলের মানুষ হয় কৃষিজীবী, না হয় মৎস্যজীবী। পুজো কমিটির সভাপতি এ বার তারাপদ হালদার। কিন্তু উদ্যোক্তাদের অন্যতম, বরদানগর গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত মণ্ডল খ্রিস্টান। তারাপদবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘এখানে আমরা সবাই মিলেমিশে এক। বরকতনগরে বড়দিন উপলক্ষে খ্রিস্টানদের বিরাট মেলা হয়। আমিই তো গিয়ে বাজনা বাজাই।’’ পুজো কমিটির এ বারের সম্পাদক শ্যামল খাঁয়ের কথায়, ‘‘পুজোয় আমরা সবাই এক। কোনও ভেদাভেদ নেই।’’
বোধ হয় সেই জন্যই তুলসী মালা থাকে রশিদ বৈদ্যের গলায়। ওই দুপুরে দেখা গেল, মণ্ডপে গিয়েই আগে জোড়হাতে মা দুর্গাকে প্রণাম করলেন রশিদ, তার পর হাত দিলেন কাজে।
১৯৭৬-এ শুরু হওয়া এই পুজোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার নাম মকবুল গাজি। দমকল পুরকাইতপাড়ার ওই বাসিন্দার ছেলে ইয়াসিন গাজি এখন ৩৫ জনের পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে দুর্গাপুজো শুধু হিন্দুদের নয়, আমাদের সকলের উৎসব। সবাই চাঁদা তুলতে বেরোই, চাঁদা দিই, প্রতিমা দর্শন করি।’’
ধর্ম আচরণে পার্থক্য আছে, কিন্তু দুর্গাপুজোকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের উৎসব বলেই ভাবেন এ তল্লাটের মানুষ। পুরকাইতপাড়ায় সূরযমল নাগরমল প্রাথমিক স্কুলের সামনে ইদের নমাজ পড়া হয় যে মাঠে, সেখানেই নবদুর্গাপুজো। লাল সিমেন্টের বেদিতে শ্বেতপাথরের গায়ে কালো হরফে যেখানে লেখা ‘পবিত্র ইদগাহ’, তার দু’হাতের মধ্যেই বেলগাছে সিঁদুর দিয়ে ষষ্ঠীতে বোধন হয়। ইন্দ্রজিৎ পুরকাইত, সৌমিত্র হালদারদের কথায়, ‘‘এমনও হয়েছে, পুজোয় মাইক চলছে আর তখন নমাজ পড়া হবে। মাইক বন্ধ হয়েছে। তার পর নমাজ শেষ হলে ফের মাইক বেজেছে। সবাই তো আসলে একই!’’
অদূরে উত্তর বরদানগরের পুজোও একই রকম সর্বজনীন। পুজো কমিটির সম্পাদক আশিস বেরা বলেন, ‘‘এই পুজোয় সামিল হওয়া মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। পুজোর উদ্যোক্তা মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু মানুষ।’’ এই সব পুজোয় সবাই পাত পেড়ে বসে খিচুড়ি ভোগ খান।
তবু কলকাতার মতো প্রচার এখানে নেই। গত এক যুগ এই পুজোর উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই শারদ সম্মান চালু করেন ভূমিপুত্র ভৃগুরাম হালদার। কঙ্কনদিঘি গ্রাম পঞ্চায়েতের ডাক্তারঘেরি গ্রামের ভৃগুরাম পেশায় কৃষক ও মৎস্যজীবী আর নেশায় পরিবেশকর্মী। তাঁর কথায়, ‘‘ এরা যাতে পরিবেশ সচেতন হয়, সুষ্ঠু ভাবে সব কিছু করে, সেই জন্যই সীমিত সামর্থ্যে এই ব্যবস্থা।’’
আর তার ফল? বছর সাতেক আগে মণ্ডলপাড়ার পুজোয় এক যুবক মদ খেয়ে পুজো প্রাঙ্গণে ঢুকে ধরা পড়ে যান। তাঁকে সবার সামনে অন্যায় কবুল করানো হয়। তার পর কোনও দিন ওই পুজোয় কেউ মদ খেয়ে ঢুকতে সাহস পায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy