E-Paper

বেতন বছরে ছয় লক্ষ, ইডির দাবি, শান্তনুর সম্পত্তি কোটি কোটি টাকার! নেপথ্যে কোন রহস্য

কুন্তল দুর্নীতিতে সামনে এলেও কার্যত তাঁর ‘গুরু’ ছিলেন শান্তনু। কলকাতার ই এম বাইপাস সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্নীতির কাজ চলত এবং সেখানেই তাপস গিয়ে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৩ ০৭:০৩
Santanu banerjee.

সিজিও কমপ্লেক্স থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শান্তনুকে (মাঝে)। শনিবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমে তাঁর বেতন বাবদ বছরে আয় ৬ লক্ষ টাকা। অথচ সেই তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় কোটি-কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বলে কোর্টে দাবি করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শুক্রবারই রাজ্য যুব তৃণমূলের প্রাক্তন সহ-সভাপতি, হুগলির বলাগড়ের বাসিন্দা শান্তনুকে গ্রেফতার করেছে ইডি। শনিবার তাঁকে কলকাতার মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শ্রীপর্ণা রাউতের আদালতে তোলা হয়। সেখানেই আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির কথা তুলে ধরতে হোটেল, রিসর্ট-সহ অন্তত কুড়িটি সম্পত্তির কথা জানিয়েছে ইডি। তদন্তকারীদের দাবি, শান্তনু নিয়োগ দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত। দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা সম্পত্তিতে এবং স্ত্রী-সহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাদা করা হয়েছে। এখন শান্তনুর পিছনে কে বা কারা ছিলেন, দুর্নীতির টাকা শান্তনু কোন ‘প্রভাবশালী’দের দিতেন, তদন্তে তা জানার চেষ্টা করবে কেন্দ্রীয় সংস্থা।

প্রিয়াঙ্কার সংস্থাও তদন্তকারীদের আতশকাচের তলায়। প্রিয়াঙ্কার জমা দেওয়া সম্পত্তি এবং আয়করের হিসাবে অসঙ্গতি পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ইডি সূত্রের দাবি, ধৃত তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ এবং বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ সংগঠনের সভাপতি তাপস মণ্ডলের সঙ্গে একযোগে দুর্নীতির চক্র চালিয়েছেন শান্তনু।

ইডি সূত্রের দাবি, কুন্তল দুর্নীতিতে সামনে এলেও কার্যত তাঁর ‘গুরু’ ছিলেন শান্তনু। ওই সূত্রের আরও দাবি, কলকাতার ই এম বাইপাস সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্নীতির কাজ চলত এবং সেখানেই তাপস গিয়ে কুন্তল এবং শান্তনুর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছিলেন। সাড়ে ১৯ কোটি টাকার লেনদেনও হয়েছিল। ইডি সূত্রের অভিযোগ, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘প্রভাবশালীদের’ কাছে পৌঁছে দিয়েছেন শান্তনু। বাকি টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করেছেন। শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষক নয়, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও শান্তনুর যোগসূত্র আছে বলে মনে করছে ইডি। গত জানুয়ারিতে শান্তনুর বাড়িতে তল্লাশি করে চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা-সহ নিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক নথি উদ্ধার করেছিলেন তদন্তকারীরা। সেগুলি যাচাই করার পরে নিয়োগ দুর্নীতিতে এই তৃণমূল নেতার যোগসাজশ নিয়ে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।

এ দিন দুপুরে আদালতে আসার পথে শান্তনু দাবি করেন, ‘‘আমি নির্দোষ। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। জেল থেকে চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, ‘জেল থেকে ফাঁসানো’ বলে কার্যত কুন্তল এবং তাপসের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছেন শান্তনু।

আদালতে শান্তনুর জামিনের আবেদন করে তাঁর আইনজীবী বলেন, ‘‘নিয়ম মেনে শান্তনুকে গ্রেফতার করা হয়নি। তাঁর পরিবারের কাউকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানানো হয়নি। শান্তনু তদন্তে সহযোগিতা করেছেন। তিনি এক জন রাজনৈতিক নেতা। স্বাভাবিক ভাবে তাঁর বাড়ি থেকে চাকরির সুপারিশপত্র ও তালিকা পাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ মেলে না।’’ ওই আইনজীবীর অভিযোগ, শান্তনুর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া তালিকা থেকে কারা কারা চাকরি পেয়েছেন তা স্পষ্ট করছে না ইডি। শুধু তাপস মন্ডলের বয়ানের ভিত্তিতে শান্তনুকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি ধৃতকে ১৪ দিনের জন্য হেফাজতে পাওয়ার আর্জি জানিয়ে বলেন, ‘‘গ্রেফতারের পর শান্তনুর স্ত্রীকে ল্যান্ডলাইন এবং মোবাইল থেকে ফোন করা হয়েছে। তিনি অ্যারেস্ট মেমো নিতে অস্বীকার করেন। শান্তনু নিজে ওই নথিতে সই করেছেন। গ্রেফতারের বিষয়টি তাঁর স্ত্রীকে জানানো হয়েছে, তা-ও লিখেছেন। স্ত্রী অ্যারেস্ট মেমো না-নিতে এলে আমাদের কিছু করার নেই।’’ ফিরোজ জানান, রাজনৈতিক নেতা হলেও শান্তনুর বাড়িতে চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা থাকতে পারে না। ওই তালিকা থেকে অনেকেই চাকরি পেয়েছেন। কালো টাকা সাদা করার এই দুর্নীতিতে শান্তনু পরিবারকেও জড়িয়ে নিয়েছেন।

দু’পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর বিচারক সোমবার পর্যন্ত শান্তনুর ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার কেস ডায়েরি-সহ শান্তনুকে কলকাতার বিচার ভবনে সিবিআই (পিএমএলএ) বিশেষ আদালতে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ইডির অন্যতম আইনজীবী অভিজিৎ ভদ্র এ দিন জানান, এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে ১১১ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া নগদ প্রায় ৫০ কোটি টাকা এবং সাড়ে চার কোটি টাকার মূল্যের সোনার গয়নাও আছে।

শান্তনুকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গে এ দিন বালুরঘাটে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় হুগলি জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষের পদ সামলাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মাখামাখির ছবি রয়েছে। এঁরা ২০ শতাংশ রেখেছেন। বাকি আশি শতাংশ টাকা কোথায় গেল, তার হিসাব দরকার। সেটা যাঁদের পকেটে ঢুকেছে, তাঁদেরও গ্রেফতার করা উচিত।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Recruitment Scam Santanu Banerjee Enforcement Directorate

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy