Advertisement
E-Paper

একটু পানি চেয়েছিল দিতে পারিনি

ঝুড়িটা মাথা থেকে ছিটকে পড়তেই খোয়াগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল চার দিকে। সেকেন্ড কয়েক স্তব্ধতা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা তৌসিফ এ বার নিজেও পড়ে গেল হাঁটু মুড়ে। মাখড়া গ্রামের মাঝ বরাবর সিমেন্টের কাঁচা ঢালাইয়ের রাস্তা মাড়িয়ে তখন মরিয়া হয়ে ছুটছেন গ্রামবাসীরা। চোখ বন্ধ করে সোমবার সকালের ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শেখ সাবির আলি। মাখড়ায় তৃণমূলের ‘হার্মাদ’ বাহিনীর আক্রমণের প্রথম বলি, সতেরো বছরের তৌসিফের দাদা।

মহেন্দ্র জেনা ও দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৭
পেট ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি।  সিউড়ি হাসপাতালে মাখড়াগ্রামের শেখ তৌসিফ আলির নিথর দেহ। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

পেট ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি। সিউড়ি হাসপাতালে মাখড়াগ্রামের শেখ তৌসিফ আলির নিথর দেহ। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

ঝুড়িটা মাথা থেকে ছিটকে পড়তেই খোয়াগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল চার দিকে।

সেকেন্ড কয়েক স্তব্ধতা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা তৌসিফ এ বার নিজেও পড়ে গেল হাঁটু মুড়ে।

মাখড়া গ্রামের মাঝ বরাবর সিমেন্টের কাঁচা ঢালাইয়ের রাস্তা মাড়িয়ে তখন মরিয়া হয়ে ছুটছেন গ্রামবাসীরা।

চোখ বন্ধ করে সোমবার সকালের ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শেখ সাবির আলি। মাখড়ায় তৃণমূলের ‘হার্মাদ’ বাহিনীর আক্রমণের প্রথম বলি, সতেরো বছরের তৌসিফের দাদা।

সোমবার সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে শুয়ে এক টানা বলে চলেছেন, “ভাইটাকে একটু পানি দিতে পারলাম না রে...একটু পানি চেয়েছিল শুধু!”

এ দিন বেলা এগারোটা নাগাদ তৃণমূলের ‘আক্রমণ’ শুরু হতেই সাবির শুনেছিলেন, মোটরবাইকের আওয়াজ, আর থেকে থেকেই ‘ফট ফট’ শব্দ। অচেনা শব্দটা ‘ঠাওর’ করতে পারেননি তিনি। সাবির বলছেন, “গুলি চলছে ঠাওর করতে পারিনি। অন্যদের পালাতে দেখে কাজ ফেলে আমিও পালাতে যাব, দেখি ভাইয়ের মাথা থেকে ঝুড়িটা ঝড়াৎ করে পড়ে গেল।” আর, তার পরেই চোখের সামনে দেখলেন মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে তৌসিফ। ছুটে যেতেই শুনেছিলেন, “ভাইটা বার কয়েক বলল, পানি-পানি। আমি এ দিক ও-দিক তাকিয়ে কোথাও পানি খুঁজে পেলাম না।” গ্রামের অন্যদের সঙ্গে পাঁজাকোলা করে তৌসিফকে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ে নিয়ে গেলেও পানি আর দেওয়া হয়নি তার মুখে। সে আক্ষেপটা যাচ্ছে না সাবিরের।

তিনি বলছেন, “হাসপাতালে নিয়ে গেলেও ভাইটা হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু বোমা-গুলির মধ্যে সে সুযোগটাও পেলাম কই! তিন ঘণ্টা পড়ে থেকে চোখের সামনে দেখলাম ভাইটা আস্তে আস্তে নেতিয়ে গেল।”

গ্রাম দখলের ‘লড়াই’ থিতিয়ে গেলে তৌসিফকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিউড়ি সদর হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে তার দিদি তনজিরা বিবির আক্ষেপ, “ভাইটা রাস্তার কাজ করছিল। তৃণমূলের বাইক-বাহিনী তাকেও রেয়াত করল না গো!” তৌসিফের বাবা শওকত আলি গুলি চালাচালির সময়ে বাড়ি ছিলেন না। বলছেন, “শুনলাম ছেলেটা রাস্তায় কাজ করছিল। আমি বিজেপি করি বলে ছেলেটাকেও মারতে হবে?”

এলাকা দখল, পুনর্দখলের সেই চেনা রাজনীতির শিকার তৌসিফ রাজনীতির ধার-কাছ দিয়েও যেত না। তাঁর দাদাও বলছেন, “ভাইটা তো কিছু বুঝতো না গো, ওটাকেও মেরে দিল তৃণমূল!” একদা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ পরিবারটি যে ক্রমে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে পড়ছিল, তা আড়াল করছেন না সাবির। তবে ‘দলবদলের’ ছায়া পড়েনি তৌসিফের উপরে। গ্রামবাসীরা জানান, ‘ও সবের’ (রাজনীতি) সঙ্গে কোনও সংস্রবই ছিল না সদ্য কিশোর ছেলেটার। তবুও শেষতক রাজনীতির দখলদারির লড়াই ছিনিয়ে নিল তাকে। এক গ্রামবাসীর কথায়, “ওরা রাজনীতি করে আর আমাদের মতো উলুখাগড়াগুলো মরে!”

এলাকা দখলের রাজনীতিতে সেই ‘উলুখাগড়া’র তালিকায় শেষ সংযোজন তৌসিফ।

তবে সোমবারের ‘লড়াই’য়ে মারা গিয়েছেন দুই তৃণমূল কর্মীও। বোমা গুলির লড়াই থিতিয়ে গেলে মাখড়া গ্রাম থেকে পুলিশ ওই দেহগুলি উদ্ধার করে।

তাদের অন্যতম শেখ সোলেমানের বিরুদ্ধে অবশ্য বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বাম জমানায় দুবরাজপুর সালুঞ্চি এলাকায় সিপিএম বিরোধী অভিযানে প্রথম সারিতেই থাকতেন তিনি। ইলামবাজার ব্লক তৃণমূল নেতা জাফারুল ইসলামের ঘনিষ্ট সোলেমানের নেতৃত্বেই এ দিন গ্রামে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল বলে গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ। মাখড়া গ্রামে সম্প্রতি বিজেপি-র উত্থানের পরে বেশ কয়েক জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থককে ঘরছাড়া হয়েছিল। এ দিন তারই বদলা নিতে ‘কাজের ছেলে’ সোলেমানদের ডাক দিয়েছিল জাফরুল বলে পুলিশের একটি সূত্রের খবর। পুলিশের অনুমান, তাকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে।

মৃত অন্য তৃণমূল কর্মী, মোজাম্মেল শেখ এলাকায় পরিচিত নেতা। তার দাদা এনামুলও তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। এ দিনের অভিযানে গ্রামের বিজেপি পরিবারগুলির বাড়ি, বহিরাগত দুষ্কৃতীদের চিনিয়ে দিতেই মোজাম্মেলকে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছিল বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। তার মদতে এক সময়ে গ্রামের বেশ কিছু বিজেপি সমর্থককে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল বলে খবর। গ্রামবাসীর সেই ক্ষোভেরই শিকার হয়েছেন তিনি। বাড়িতে ঢুকে তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।

makhra mahendra jena dayal sengupta anubrata mondal tousif ali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy