কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় বাংলার দুই মন্ত্রীর মধ্যে অন্যতম দেবশ্রী চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।
এক নিস্তেজ নির্বাচনে ধুন্ধুমার লড়াই চিনিয়েছিল তাঁর নামটা। তার পরে কেটে গেল ১৮টা বছর। তিনি অবতীর্ণ হলেন এক ধুন্ধুমার নির্বাচনে, উতরেও গেলেন সসম্মানে এবং সরাসরি পৌঁছে গেলেন ভারত সরকারের মন্ত্রিসভায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে অনেককেই সাংঘাতিক চমকে দিলেন দেবশ্রী চৌধুরী।
রাজ্য বিজেপির পাঁচ সাধারণ সম্পাদকের অন্যতম তিনি। কিন্তু বিজেপি এ রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পর থেকে সেই পাঁচ জনের মধ্যে সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের উপরে সারা বছর যে ভাবে থাকত ক্যামেরার ফোকাস, দেবশ্রী চৌধুরীর উপরে তেমনটা কিন্তু থাকত না। প্রথম চমকটা এসেছিল প্রার্থী তালিকার মধ্যে দিয়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তর দিনাজপুর জেলায় তুমুল অশান্তি বা দাঁড়িভিট গ্রামে গুলিতে দুই ছাত্রের মৃত্যু বা প্রবল মেরুকরণের হাওয়ায় রায়গঞ্জ লোকসভা আসন যখন বিজেপির জন্য প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছিল, তখন রাজনৈতিক শিবিরের অনেকেই ভেবেছিলেন, খুব ওজনদার কোনও নামকে রায়গঞ্জে প্রার্থী করে আসনটাকে আরও নিশ্চিত করে নেবে বিজেপি। কিন্তু প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হয় অপেক্ষাকৃত লো-প্রোফাইলের দেবশ্রীকে। বাইরে তো বটেই, রাজ্য বিজেপির অন্দরেও অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। মহম্মদ সেলিম বা দীপা দাশমুন্সিদের মতো রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের বিরুদ্ধে দেবশ্রী কতটা এঁটে উঠতে পারবেন, তা নিয়ে বিজেপির ভিতরেই সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছিল একটি অংশ। তখন সত্যিই আঁচ করা যায়নি, কত বড় উত্থান অপেক্ষা করছে বালুরঘাটে সেবিকা সমিতির শাখা থেকে উঠে আসা এই বিজেপি নেত্রীর।
বালুরঘাটের মেয়ে দেবশ্রী। ছোট থেকেই সংযোগ সঙ্ঘের সঙ্গে। বঙ্গ বিজেপির মিডিয়া ইনচার্জ সপ্তর্ষি চৌধুরীর কথায়, ‘‘দেবশ্রীদির শিকড় সঙ্ঘেই। সেবিকা সমিতিতে ছিলেন। তার পরে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। ১৯৯৯-২০০০ সাল নাগাদ, মানে আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র, তখনও দেবশ্রীদি বিদ্যার্থী পরিষদেই। তার পরে গেলেন যুব মোর্চায়।’’
আরও পড়ুন: গত ৪৫ বছরে দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ, ফাঁস হওয়া রিপোর্টকেই সত্য মানল কেন্দ্র
নেহাৎই সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসে ভারত সরকারের মন্ত্রী হওয়া দেবশ্রীর পড়াশোনা সুদূর মফস্সল বালুরঘাটেই। খাদিমপুর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। তার পরে বালুরঘাট কলেজে। কলেজ জীবনেই এবিভিপি-তে নজর কাড়েন সাংগঠনিক স্তরে। ফলে যুব মোর্চায় তাঁর উত্তরণও ঘটে দ্রুতই। কিন্তু রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর নামটা প্রথম বার চর্চায় এসেছিল ২০০৬ সালে।
বাম জমানার দোর্দণ্ড প্রতাপ মন্ত্রী তথা আরএসপি নেতা বিশ্বনাথ চৌধুরী এবং বালুরঘাট তখন সমার্থক। ২০০১ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ছুড়ে দেওয়া প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে যখন বাংলার নানা প্রান্তে ইন্দ্রপতন ঘটে গিয়েছিল, তখনও অটুট ছিল বিশ্বনাথ চৌধুরীর গড়। তার পরের বিধানসভা নির্বাচনে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে, সে অর্থে কোনও চ্যালেঞ্জই ছিল না বামেদের সামনে। কংগ্রেস আলাদা লড়ছিল। ১ সাংসদের দলে পরিণত হওয়া তৃণমূল লড়ছিল ততোধিক দুর্বল বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে। সপ্তম বারের জন্য বামফ্রন্টের ক্ষমতায় ফেরা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল।
আরও পড়ুন: সম্বল সাইকেল, বাস কুঁড়েঘরে, মন্ত্রী হলেন সাধু হতে চাওয়া ‘ওড়িশার মোদী’
এ হেন নির্বাচনে বালুরঘাট বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল সমর্থিত বিজেপি প্রার্থী ছিলেন দেবশ্রী চৌধুরী। দাপুটে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমেও প্রচারে যে ভাবে দাপট দেখিয়েছিলেন যুবনেত্রী, সে কথা এখনও মুখে মুখে ফেরে। তাই ২০১৯ সালে ভারত সরকারের মন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেবশ্রী চৌধুরী শপথ নেওয়ার পরের দিন দিল্লি থেকে ফিরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা বিজেপির সভাপতি শুভেন্দু সরকার স্মৃতিচারণে চলে যান। বলেন, ‘‘২০০৬ সালে যে লড়াই দেবশ্রী চৌধুরী দিয়েছিলেন বালুরঘাটে, তা এলাকার লোকের এখনও মনে আছে। হেরে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ওই রকম একটা একতরফা নির্বাচনেও প্রতিপক্ষকে যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানো যায়, তা দেবশ্রী চৌধুরী দেখিয়েছিলেন।’’
তার পরেও নির্বাচনে লড়েছেন দেবশ্রী চৌধুরী। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন। রাজনীতিতে তখন আনকোরা বাবুল সুপ্রিয় পাশের আসন আসানসোল থেকে জিতলেও দেবশ্রী চৌধুরী বর্ধমান-দুর্গাপুরে সে ভাবে দাগ কাটতে পারেননি। কিন্তু দলের দেওয়া যে কোনও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি থেকে কখনও পিছু হঠেননি। পুরস্কার হিসেবে পেয়ে গেলেন রায়গঞ্জের টিকিট। নানা জল্পনা নস্যাৎ করে অবশেষে জিতেও এলেন।
কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। বাংলা থেকে বিজেপির টিকিটে জিতলেন ১৮ জন। অন্তত ২ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং আরও কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী হবেন বলে জল্পনা শুরু হল। গোটা দশেক নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হল। শেষ পর্যন্ত পূর্ণমন্ত্রী পদে শিকে ছিঁড়ল না কারও। বাংলার জন্য বরাদ্দ হল মাত্র দুটো প্রতিমন্ত্রিত্ব। তার মধ্যে একটা আবার গেল আগের বারও প্রতিমন্ত্রী পদে থাকা বাবুল সুপ্রিয় কাছে। পড়ে রইল আর একটা। সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে সেই পদটা দেবশ্রী চৌধুরীর হাতে গেল কী ভাবে? কোন সমীকরণে? চর্চা সবচেয়ে বেশি এখন এই প্রশ্নকে ঘিরেই।
সমীকরণটা স্পষ্ট হচ্ছে বিজেপির অন্দরে কান পাতলেই। বাবুল সুপ্রিয় মন্ত্রী হচ্ছিলেন দক্ষিণবঙ্গ থেকে। সুতরাং দ্বিতীয় জনকে উত্তরবঙ্গ থেকেই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর উত্তরবঙ্গের সাংসদদের মধ্যে আর কারও শিকড় সঙ্ঘ বা বিজেপিতে দেবশ্রী চৌধুরীর চেয়ে বেশি গভীরে ছিল না।
দার্জিলিঙের রাজু বিস্তা, আলিপুরদুয়ারের জন বার্লা, কোচবিহারের নিশীথ প্রামাণিক বা উত্তর মালদহের খগেন মুর্মু বিজেপিতে একেবারেই নতুন। জলপাইগুড়ি থেকে জয়ী জয়ন্ত রায় সক্রিয় রাজনীতিতে একদম আনকোরা। পড়ে রইলেন রায়গঞ্জ থেকে জয়ী দেবশ্রী চৌধুরী এবং বালুরঘাট থেকে জয়ী সুকান্ত মজুমদার। দেবশ্রীর মতো সুকান্তর শিকড়ও সঙ্ঘে। কিন্তু দেবশ্রী চৌধুরী রাজ্য বিজেপিতে যতখানি উপরে উঠে গিয়েছিলেন, সুকান্ত মজুমদার তার ধারেকাছেও ছিলেন না।
আরও একটা বিষয় সম্ভবত মাথায় ছিল বিজেপি নেতৃত্বের। সুকান্ত মজুমদারকে মন্ত্রিসভায় পাঠালে শুধু বালুরঘাটের প্রতিনিধিত্ব থাকত। কিন্তু দেবশ্রী চৌধুরী সাংসদ হিসেবে রায়গঞ্জের প্রতিনিধি হওয়ার পাশাপাশি ভূমিকন্যা হিসেবে বালুরঘাটেরও।
অতএব দেবশ্রী চৌধুরীর চেয়ে বেশি উপযুক্ত হিসেবে আর কাউকে চিহ্নিতই করতে পারলেন না বিজেপি নেতৃত্ব। আর দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে নিতান্ত সাধারণ প্রোফাইলে রাজনীতি করা দেবশ্রী চৌধুরী প্রায় রাতারাতি পৌঁছে গেলেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের শাসন ক্ষমতার সর্বোচ্চ অলিন্দে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy