Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘ছন্দ ও শব্দ ছিল তাঁর ক্রীতদাস’

আমি বরাবর নীরেনদার কবিতার ভক্ত। কোনও দিনই তিনি এলায়িত কাব্যভাষার আমদানি করেননি। ছন্দ ও শব্দ ছিল তাঁর ক্রীতদাস।

কবির সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে। —ফাইল চিত্র।

কবির সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে। —ফাইল চিত্র।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০৯
Share: Save:

শুধু দেহের দীর্ঘ আয়ুষ্কাল কোন স্রষ্টারই বা কাঙ্ক্ষিত? তিনি চান তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ আয়ু, আর তার ভিতর দিয়েই তিনি অন্য এক বেঁচে থাকাকে খুঁজে নেন। নীরেন্দ্রনাথ চুরানব্বই বছর বয়সে প্রয়াত হওয়ার অব্যবহিত আগেও সৃষ্টিশীল ছিলেন। মাত্রই কিছু দিন আগে তাঁর দীর্ঘ এক অনবদ্য কবিতা প্রকাশ পেয়েছে, যা পাঠ করে বিস্ময় জেগেছিল বয়স এখনও তাঁকে ছুঁতে পারেনি দেখে।

আমি বরাবর নীরেনদার কবিতার ভক্ত। কোনও দিনই তিনি এলায়িত কাব্যভাষার আমদানি করেননি। ছন্দ ও শব্দ ছিল তাঁর ক্রীতদাস। ছোটদের ছড়ায়, বড়দের কবিতায় তিনি দু’রকম নীরেন্দ্রনাথ। দুই ধারার মাঝখানে তিনি আগল তুলতে পারতেন, যা মাত্র কেউ কেউ পারে। মনে আছে শিবরাম চক্রবর্তীর একটি কার্টুন ছবি— একটা লোকের নাকের ডগায় এক পাখি বসে আছে। এই ছবিকে কেন্দ্র করে কয়েক জনকে ছড়া লিখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ডাকসাইটেরাই লিখেছিলেন। কিন্তু নীরেনদার ছড়াটা আজও ভুলতে পারি না, ছন্দের অবাক চালের জন্য। ক’টা লাইন এখনও মনে আছে৷ ‘‘রাম কি কিরিয়া বাবা/ এ কৌন চিড়িয়া বাবা/ আজই/ দুখিয়া দিনে কি রেতে/ মুলুকমে চলে যেতে রাজি।’’

যখন নীরেনদাকে প্রথম দেখি তখনই ভারী সম্ভ্রম হয়েছিল। গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে একমাথা উঁচু। ছিপছিপে, ক্ষুরধার মুখশ্রী আর ভাবাশ্রয়ী চোখের জন্য সব সময়েই দৃষ্টিগোচর হতেন। হাঁটতেন দ্রুত, চটি পরা পায়ে। পরনে সর্বদাই ধুতি পাঞ্জাবি। অলস সময় কাটাতে তাঁকে কখনও দেখা যেত না। তখন তিনি ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক। আর কে না জানে, তাঁর সম্পাদনাকালে পত্রিকাটির বড় সুসময় গেছে!

আমাদের মতো কয়েক জন অর্বাচীন তখন লেখালেখির চেষ্টা করছি। নীরেনদা পরম স্নেহে আমাদের লালন করেছেন। আমি তো কখনও কিশোরদের জন্য লেখার কথা ভাবিইনি। নীরেনদাই এক দিন জোর করে আমাকে দিয়ে লেখালেন। সুনীল আর শক্তিকে আকণ্ঠ ভালবাসতেন। বিস্তর কবি আর সাহিত্যিক তাঁর অজচ্ছল প্রশ্রয় পেয়েছেন। বাংলা বানানের ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না।

নীরেনদা এত কর্মব্যস্ততা, বিস্তর ঘোরাঘুরি সামাল দিয়েও কিন্তু খুব পরিবারমুখী মানুষ ছিলেন। তাঁর নানা কথায় সুগভীর বাৎসল্য আর পত্নীপ্রেমের প্রকাশ ঘটত। এই সে দিনও দেখেছি, তাঁর ছেলে-মেয়ে-জামাই ও বৌমা একজোট হয়ে তাঁকে সাহচর্য দিচ্ছেন। অথচ তাঁর দুটি মেয়ে, দুই জামাই, ছেলে-বৌমা সকলেই বিশেষ কৃতবিদ্য এবং খ্যাতনামা। পরিবারকে এ ভাবে এককাট্টা করে রাখাটা এই ভাগাভাগির যুগে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

এক বার ‘দেশ’ পত্রিকার ঘরে বসে কাজ করছি। নীরেনদা সটান এসে আমাকে নড়া ধরে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘আয় তো আমার সঙ্গে, দরকার আছে।’’ সবাই অবাক হয়ে দেখছে, নীরেনদা শীর্ষেন্দুকে পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছেন। নীরেনদা আমাকে সোজা তাঁর ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বলে গেলেন, ‘‘আনন্দমেলার জন্য একটা গল্প লিখে শেষ করলে ছুটি পাবি।’’ ‘আনন্দমেলা’র ছেলেদের অবশ্য চা আর সিগারেটের কথা বলে গিয়েছিলেন। ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় আমি ‘ডবল পশুপতি’ নামে একটা গল্প লিখি। এর মধ্যে যে নিগূঢ় ভালবাসা আর আস্থা আছে, সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কয়েক মাস আগে সাহিত্য আকাদেমি নীরেনদাকে জীবনকৃতি সম্মান দিল। আমি তাঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলাম, ‘‘নীরেনদাকে আমি বড় ভালবাসি।’’ রাতে নীরেনদা ফোন করে বললেন, ‘‘ওরে আমিও যে তোকে কতটা ভালবাসি, জানিস?’’

অনেকে হয়তো জানেন না, ‘ফ্যান্টম হু ওয়াকস’ নামে কমিক স্ট্রিপটির বঙ্গানুবাদ করেন নীরেনদা। ফ্যান্টমের নাম তিনিই দেন ‘অরণ্যদেব’। তা এতই জনপ্রিয় যে, মূল নামটি অনেকে ভুলেই গেছেন। অ্যাস্টেরিক্স এবং টিনটিনের অনুবাদ পড়লে মনে হয়, বুঝি বাংলাতেই মূলটি লেখা। এ শুধু ভাষান্তর বা ভাবানুবাদ নয়, বোধহয় মর্মান্তর বললে কাছাকাছি যাওয়া যায়। এক বেলজিয়ান কবির কিছু কবিতা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদ এত হৃদয়গ্রাহী যে, বেলজিয়াম সরকার তাঁকে গবেষণার জন্য বেলজিয়ামে আমন্ত্রণ জানান। বেশ কিছু দিন ছিলেনও সেখানে। হঠাৎ একদিন পাশের বাড়িতে আগুন লেগে দু’টি অরক্ষিত শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় বিপর্যস্ত বোধ করে ফিরে আসেন। কোমলহৃদয়, আদ্যন্ত পরিবারমনস্ক নীরেনদার পক্ষে এই ঘটনার অভিঘাত সহনীয় ছিল না। তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘‘আমি কল্পনাপ্রবণ মানুষ নই। চারদিকে যা দেখি আর শুনি তাই নিয়েই আমি লিখি।’’ তাই যদি হবে, তা হলে কি ‘কলকাতার যিশু’ বা ‘অমলকান্তি’ লিখতে পারতেন? আমি জানি ওটা বিনয়মাত্র। যে জিনিসটার বড় অভাব আজ দেখতে পাই চারদিকে।

অকালপ্রয়াণ তো নয়, তবু সব প্রয়াণকেই আমার অকালপ্রয়াণ বলেই যে কেন মনে হয়। মনে হয় বেশ তো ছিলেন। এক কবিতায় মৃত্যুর উদ্দেশে বলেওছিলেন, আমার যাওয়ার কোনও তাড়া নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE