E-Paper

বিরল রোগের সরকারি চিকিৎসায় দুই মেরুতে আবেগ ও বাস্তবতা

চিকিৎসাযোগ্য বিরল অসুখকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে থাকা অসুখের এককালীন খরচ বেশি হলেও তা আয়ত্তের মধ্যে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকা অসুখে ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগলেও তার খরচ অল্প। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অসুখের চিকিৎসার খরচ অত্যধিক বেশি।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৫ ০৮:২১
বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতে বিরল রোগ নিয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতে বিরল রোগ নিয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে। —প্রতীকী চিত্র।

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) আক্রান্ত দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে এক বাবা-মা যখন বিরল রোগের ক্লিনিকে আসেন, তখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ছিল তাঁদের উদ্বিগ্ন চোখে-মুখে। ছেলে ও মেয়ে দু’টির বাবা-মা দু’জনেই জিনগত ওই রোগের বাহক। বাবা ও মায়ের থেকে প্রাপ্ত জিন ওদের শরীরে রোগের প্রকাশ ঘটিয়েছে। দম্পতির শিশুপুত্রের বিরল এই রোগ ধরা পড়ার আগেই জন্ম নেয় তাঁদের শিশুকন্যা। সময়ের সঙ্গেই সামনে আসে, দু’জনেই এসএমএ আক্রান্ত।

তবে দম্পতির ধারণা, সরকারি সাহায্যে দু’জনেই সুস্থ হয়ে উঠবে। এই ধারণা আংশিক সত্য। যে সব বিরল রোগের চিকিৎসা সম্ভব, সেই সব রোগে আক্রান্তদের নাম নথিবদ্ধ করা ও চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১ সালে ‘ন্যাশনাল রেয়ার ডিজ়িজ় পলিসি’ চালু করে ও কয়েকটি উৎকর্ষ কেন্দ্র (সি ও ই) তৈরি করে। এই কেন্দ্রগুলি থেকে বিরল অসুখের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছাড়াও বিশেষ খাদ্যাভ্যাস (ডায়েট), প্রতিষেধক-সহ অন্যান্য সাহায্য করা হয়। পূর্ব ভারতের অন্যতম কেন্দ্রটি এই রাজ্যে আইপিজিএমইআর, এসএসকেএম হাসপাতাল।

এই সব চিকিৎসাযোগ্য বিরল অসুখকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে থাকা অসুখের এককালীন খরচ বেশি হলেও তা আয়ত্তের মধ্যে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকা অসুখে ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগলেও তার খরচ অল্প। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অসুখের চিকিৎসার খরচ অত্যধিক বেশি। তাই সমস্যা মূলত এই রোগীদের নিয়ে। যে হেতু বেশির ভাগ রোগের চিকিৎসা পঞ্চাশ লক্ষ টাকাতেই সম্ভব, তাই সর্বাধিক এই পরিমাণ অর্থ এক জন রোগীর জন্য বরাদ্দ আছে। এসএমএ-র মতো আরও একটি ব্যয়বহুল জিনগত অসুখ ডুসেন মাস্কুলার ডিস্ট্রফি বা ডিএমডি। এর চিকিৎসা বেশ কিছু দিন হল বিশ্ব বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যার খরচ কয়েক কোটি টাকার বেশি।

বিরল রোগের এই পোর্টালে এ রকম কয়েকশো বাচ্চার নাম নথিভুক্ত থাকলেও সরকারের পক্ষে এদের চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। অনেক আশা নিয়ে ক্রাউড ফান্ডিং-এর ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বাস্তবে যার মাধ্যমে কোনও সাহায্যই আসেনি। কর্পোরেট সংস্থাগুলির সিএসআর থেকেও কোনও সাহায্য এই রোগীরা পায়নি।

বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতে বিরল রোগ নিয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে। তবে, এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই অসুখগুলি নতুন বা এখন এদের সংখ্যা বেড়েছে। এই রোগাক্রান্তদের আগেও চিকিৎসকেরা দেখতেন। এই সব বিরল অসুখের বেশির ভাগেরই চিকিৎসা ছিল না। চিকিৎসকেরা ছাত্রদের দেখানো এবং শেখানোর জন্যই রোগীদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ডায়াগনসিস করার প্রয়োজনীয় পরীক্ষারও উপায় ছিল না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে বর্তমানে ভ্রূণ অবস্থা থেকেই বিরল রোগের যথাযথ ডায়াগনসিস করা সম্ভব হচ্ছে, বেশ কিছু অসুখের চিকিৎসাও হচ্ছে। কিন্তু এই চিকিৎসা বহু ক্ষেত্রেই
ব্যয়বহুল এবং সাধারণের নাগালের বাইরে। শুধু ভারতে নয়, অন্য দেশেও একই অবস্থা। অনেক উন্নত দেশে সরকার বিরল এই অসুখের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় অথবা
বিমার সুবিধা পাওয়া যায়। ভারতে রোগীর অভিভাবকদের গোষ্ঠী সম্মিলিত ভাবে দরবার করে এই রোগাক্রান্তদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারকে নিতে বাধ্য করিয়েছে বা করাচ্ছে।

লেখার শুরুতে উল্লেখ করা ভাইবোনের চিকিৎসার খরচ এতটাই বেশি যে, নির্ধারিত পঞ্চাশ লক্ষও অপ্রতুল, এক বছরের বেশি তা চালানো সম্ভব নয়। তবু বাবা-মায়ের আশা, কিছু তো হবে। চিকিৎসক হিসাবে আমরা জানি, এ আশা মিথ্যা। পঞ্চাশ লক্ষ শেষ হলে আর বরাদ্দ নেই। তখন এই শিশু এবং তাদের বাবা-মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো কঠিন। যে শিশুর ওজন বেশি, তার জন্য এই পরিমাণ অর্থ কয়েক মাস চিকিৎসার জন্যও পর্যাপ্ত নয়।

এই সমস্ত অসুখের চিকিৎসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করলে তবেই ওষুধে উন্নতির সম্ভাবনা থাকে। যখন শারীরিক অক্ষমতার জন্য শিশু চলাচল করতে পারে না বা হুইলচেয়ার-নির্ভর হয়ে পড়ে, তখন ওষুধে উন্নতির আশা ক্ষীণ। এ কথা বাবা-মাকে বোঝানো খুবই কঠিন। তাঁদের প্রশ্ন, ওষুধ থাকলে সন্তানেরা পাবে না কেন? এই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে চিকিৎসকদের ধর্মসঙ্কটে পড়তে হয়। রোগীর বাবা-মা এবং তাদের সংগঠন প্রায়ই আদালতে পৌঁছে যান। তখন মানবিক কারণে আদেশ আসে। উন্নতি হবে না জেনেও ওষুধ দিতে হয়।

তা হলে উপায়?

দেশে আইসিএমআর-এর তত্ত্বাবধানে প্রকারভেদ অনুযায়ী বিরল রোগীর সংখ্যার নথিভুক্তিকরণ চলছে। এর মাধ্যমে সরকারের ব্যয়ভার যেমন আন্দাজ করা যাবে, তেমনই অসুখগুলির চিকিৎসায় গবেষণা ও ওষুধ তৈরির পথ সুগম হবে। দেশে তৈরি ওষুধ সস্তা ও সহজলভ্য হবে। এ বিষয়ে সরকারও আগ্রহী। সম্প্রতি সিকল্ সেল ডিজ়িজ়ে আমাদের দেশে জিন থেরাপির সাফল্য দেখে অন্যান্য জিনঘটিত অসুখেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ আশা দেখায়।

ওষুধের পাশাপাশি বিরল রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট ওয়ার্ড এবং আই সি ইউ-তে শয্যা বরাদ্দের ভাবনাও চলছে। পঞ্চাশ লক্ষের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি অনুদান আরও বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। আশা করা যায়, সীমাবদ্ধতা
কাটিয়ে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এই রোগীদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়ে উঠবে।

(লেখক: স্নায়ুরোগ চিকিৎসক, এসএসকেএম)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rare Disease Medical

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy