Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তিন দিনে ধরা হোক মাথাদের, নইলে আত্মহত্যা

তিন দিনের মধ্যে রাঘব বোয়ালরা ধরা না-পড়লে আত্মহত্যা করবেন কুণাল ঘোষ। সোমবার আদালতে দাঁড়িয়ে এ বার এ রকমই হুমকি দিলেন তিনি। সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের অনেককেই যে ধরা হচ্ছে না, এই অভিযোগ কুণালের নতুন নয়। বারবারই এই নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ। পুজোর আগে পঞ্চমীর দিনও আদালতে গর্জে উঠে বলেছিলেন, “যারা সারদার কাছে সুবিধা নিয়েছেন, তারা বাইরে পুজো উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। আর আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব, এটা হতে পারে না।”

সিবিআই বিচারকের সামনে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। কিন্তু ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ছাড়ার সময় অন্য মূর্তি কুণালের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সিবিআই বিচারকের সামনে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। কিন্তু ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ছাড়ার সময় অন্য মূর্তি কুণালের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৮
Share: Save:

তিন দিনের মধ্যে রাঘব বোয়ালরা ধরা না-পড়লে আত্মহত্যা করবেন কুণাল ঘোষ। সোমবার আদালতে দাঁড়িয়ে এ বার এ রকমই হুমকি দিলেন তিনি।

সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের অনেককেই যে ধরা হচ্ছে না, এই অভিযোগ কুণালের নতুন নয়। বারবারই এই নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ। পুজোর আগে পঞ্চমীর দিনও আদালতে গর্জে উঠে বলেছিলেন, “যারা সারদার কাছে সুবিধা নিয়েছেন, তারা বাইরে পুজো উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। আর আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব, এটা হতে পারে না।” কিন্তু তখনও কুণালের আশা ছিল, রাজ্য পুলিশ প্রভাবশালীদের আড়াল করেছে। সিবিআই তা করবে না। কিন্তু এ বার সিবিআইয়ের বিরুদ্ধেও একই অসন্তোষ শোনা গেল কুণালের মুখে।

সাংসদের দাবি, সিবিআই অনেক কিছু জানে। তিনি সিবিআইকে প্রচুর তথ্য দিয়েছেন। তাঁকে দিয়ে বেশ কিছু ফাইল ও সিডি যাচাই করিয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু সে সবের প্রতিফলন চার্জশিটে নেই। অতএব কুণালের হুমকি, এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার না করা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। নগর দায়রা আদালতে এই হুমকির কথা বিচারক অরবিন্দ মিশ্র তাঁর নির্দেশে উল্লেখ করেছেন। জেলে যাতে ‘অপ্রীতিকর পরিস্থিতি’ তৈরি না হয়, তা দেখার জন্য রাজ্যের এডিজি (কারা)-কে নির্দেশও দিয়েছেন বিচারক।

কুণাল এ দিন ফের অভিযোগ করেছেন, যারা সুদীপ্তকে পনজি স্কিমের ব্যবসায় নামিয়েছিল, একের পর এক মিডিয়া সংস্থা খুলিয়েছিল, তাদের কিছু বলা হচ্ছে না। যাঁরা সারদা থেকে রাজনৈতিক প্রচার, মোটরসাইকেল পেয়েছেন, তাঁদের কিছু বলা হচ্ছে না! তিনি বলেন, “আমি চেকে টাকা নিয়ে ফেঁসে গিয়েছি। যাঁরা নগদ টাকা নিয়েছেন, তাঁরা প্রমাণ নেই বলে ছাড় পাবেন! এটা হতে দেব না।” সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে দুই শীর্ষ পুলিশকর্তার নামও এ দিন আদালতে তুলেছেন তিনি। ফের আদালতের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়ার আর্জিও জানিয়েছেন।

আলিপুর আদালতে রজত মজুমদার এবং নীতু। —নিজস্ব চিত্র

সারদায় কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের নিয়ে আগেও বারবার সরব হয়েছেন কুণাল। কখনও বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে অর্থলগ্নি সংস্থার সম্পর্ক নিয়ে নথি দাখিল করেছেন, কখনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সারদার সংবাদমাধ্যম থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। ৬ সেপ্টেম্বর এই সিবিআই আদালতেই তিনি দাবি করেছিলেন, সারদা মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা সবচেয়ে বেশি যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এ দিন সিবিআই আদালতে হাজির হওয়ার আগে ব্যাঙ্কশাল আদালতে সারদার অন্য একটি মামলায় চার্জশিট নিতে যান কুণাল। সিবিআই আদালতে ঢোকার পর থেকেই তিনি থমথমে মুখে বসেছিলেন। মাঝে মাঝে পাশে বসা সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। শুনানি শুরু হতেই বিচারক অরবিন্দ মিশ্রকে তিনি বলেন, “আমার সময় কমে আসছে। আমি বলতে না পারলে অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শেষ বারের মতো কথা বলার অনুমতি চাইছি।” বিচারক কুণালকে কথা বলার অনুমতি দেন। কাঠগড়ায় উঠে কুণাল বলেন, “আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। আমি আমার পরিবার-পরিচিতদের মুক্তি দিতে চাই।” তার পরেই হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই কাঠগড়া থেকে নেমে আদালতের লকআপে ঢুকে পড়েন। হাতে থাকা কাগজের তাড়া ছুড়ে ফেলে বেঞ্চে বসে কাঁদতে থাকেন। পাশে বসে তখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন সুদীপ্ত।

সুদীপ্ত এবং দেবযানীর আইনজীবীও এ দিন সিবিআই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা আদালতে অভিযোগ করেন, সিবিআইয়ের চার্জশিটে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খোঁজার কথা বলেছিল, তারও কোনও উল্লেখ চার্জশিটে নেই। একই কথা বলেন কুণালের আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহাও। তবে কুণাল এ দিন আর্জি জানান, প্রভাবশালীদের গ্রেফতার করার জন্য যে সময়সীমা তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে অর্থাৎ আগামী তিন দিন তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে তিনি দেখা করবেন না। পরিবার বা পরিচিতদেরও যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না দেওয়া হয়।

সারদার অন্য একটি মামলায় আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হারাধন মুখোপাধ্যায় সুদীপ্ত সেনকে জামিন দিয়েছেন। ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা পড়েনি বলেই জামিন পেয়েছেন তিনি। ওই মামলায় বাকি তিন অভিযুক্ত প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদার, ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু, ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবাল এবং অসমের গায়ক সদানন্দ গগৈ অবশ্য জামিন পাননি। আলিপুর আদালতে সদানন্দের আইনজীবী সেলিম রহমান অভিযোগ করেন, সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে তদন্ত করছে না। সিবিআই আইনজীবী তাপস বসু জানান, তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে। এই প্রভাবশালীদের জামিন দিলে তদন্তের ক্ষতি হতে পারে। আগামী ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁদের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বাকি মামলাগুলিতে জামিন না পাওয়ায় সুদীপ্তকেও জেলেই থাকতে হবে।

নগর দায়রা আদালতে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলছে। সেই মামলায় কুণালের মালিকানাধীন সংস্থা ‘স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া’র নামও রয়েছে। এ দিন আদালতে কুণাল দাবি করেছেন, স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া সারদা থেকে বিজ্ঞাপন নিয়েছে। কিন্তু এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে ওই সংস্থা জড়িত নয়। সিবিআই তাঁকে স্ট্র্যাটেজি মিডিয়া নিয়ে জেরাও করেনি। তিনি যে সারদার টাকা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন, তা প্রমাণ করার জন্য পার্ক স্ট্রিট থানার চার্জশিটও আদালতের সামনে হাজির করেন। তিনি আদালতে বলেন, পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ ‘চ্যানেল টেন’-এর এক অ্যাকাউন্টস অফিসারের জবানবন্দি চার্জশিটে জুড়ে দিয়েছে। সেই অফিসার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি অন্য এক সাংবাদিক-শীর্ষ কর্তার কাছে রিপোর্ট করতেন। ওই সাংবাদিক-কর্তাকে গ্রেফতার করার দাবিও জানান কুণাল।

এ দিন কুণালের আইনজীবী আদালতে জানান, শারীরিক অসুস্থতার জন্য কুণালকে জেলে ‘মেডিক্যাল ডায়েট’ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্সি জেল সুপারকে কারণ দর্শাতে বলেছে আদালত। জেলে শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে আদালতে অভিযোগ করেছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদারও। তিনি আলিপুর আদালতে জানিয়েছেন, জেলে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলেও সেই কাগজপত্র তাঁকে দেওয়া হয়নি।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কুণালদের পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্ট লক-আপ থেকে বেরনোর সময়ও গুম মেরে ছিলেন সাংসদ। ভ্যানে ওঠার আগে এক বার ঘুরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি আসি। আপনারা সবাই ভাল থাকবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE