Advertisement
E-Paper

‘বাধ্য হয়ে’ তৃণমূলে, আর ‘পাল্টা মারতে’ বিজেপিতে: দ্বিমুখী ভাঙনে বিপর্যস্ত কংগ্রেস

বাংলার কংগ্রেসকে প্রায় অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল। বিরাট ভাঙন ধরেছে বিধায়ক দলে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে ৪৪টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। পরে উপনির্বাচনে ২টি আসন তৃণমূলের কাছে হারিয়েছে তারা। আরও ১৭টি আসন কার্যত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বিধায়কদের দলবদলের জেরে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৮ ১৮:১৩
গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

ভেঙেই চলেছে কংগ্রেস। বিধায়ক থেকে, কাউন্সিলর, জেলা নেতা থেকে পঞ্চায়েত সদস্য— সব স্তরে ভাঙন।

সম্প্রতি আবার কিছুটা বদল এসেছে ভাঙনের গতিপ্রকৃতিতে। আগে শুধু কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার ঢল ছিল। এ বার বিজেপিতেও যাচ্ছেন কেউ কেউ। কেন এই অপ্রতিরোধ্য ধস দলে? বিরোধী শিবির থেকে শাসকের দিকে চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা তা-ও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসা যে দলের জন্য এখনও বহু দূরের গন্তব্য, সেই বিজেপি-তে কেন সামিল হচ্ছেন দীর্ঘ দিনের কংগ্রেসিরা? কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে।

বাংলার কংগ্রেসকে প্রায় অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল। বিরাট ভাঙন ধরেছে বিধায়ক দলে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে ৪৪টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। পরে উপনির্বাচনে ২টি আসন তৃণমূলের কাছে হারিয়েছে তারা। আরও ১৭টি আসন কার্যত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বিধায়কদের দলবদলের জেরে।

আরও পড়ুন: জয়ীদের ‘পাহারায়’ নেতা পাঠাবে বিজেপি

কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার এই ঢলে যখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের টালমাটাল দশা, ঠিক তখনই ভাঙন শুরু হয়েছে আরও এক প্রান্ত থেকে। কংগ্রেস ছেড়ে এ বার বিজেপি-তে যাওয়া শুরু করেছেন অনেকে। কোনও কংগ্রেস বিধায়ক এখনও পর্যন্ত বিজেপি-তে যাননি। কিন্তু একাধিক কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দাবি। এ রাজ্য থেকে কংগ্রেসের টিকিটে ২০১৪ সালে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন যে ৪ জন, তাঁদের মধ্যে অন্তত দু’জনকে নিয়েও বিজেপিতে জল্পনা শুরু হয়েছে। ২১ জুলাই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলাঞ্জন রায় অনুগামীদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। জেলায় জেলায় আরও বেশ কিছু নেতা বিজেপিতে চলে গিয়েছেন। কংগ্রেসি পঞ্চায়েত সদস্য বা পুরসভার কাউন্সিলর দল বদলে বিজেপিতে গিয়েছেন, এমন খবরও মিলেছে বেশ কয়েকটি জেলা থেকে।

আরও পড়ুন: প্যান্ডেল ভাঙা নিয়ে তোপ

কেন এই প্রবণতা? কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত বিধায়করা যাচ্ছেন তৃণমূলে। আর জেলা স্তরের নেতারা বা একেবারে নীচের স্তরের কর্মীরা চলে যাচ্ছেন বিজেপিতে। এর কারণ কী?

কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ কোনও রাখঢাক করলেন না। ভাঙন যে দলে হচ্ছে, তা একবাক্যেই মেনে নিলেন। আর ভাঙনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘বিধায়কদের দল বদলের কারণ হল পেট কা সওয়াল।’’ ‘পেট কা সওয়াল’ মানে কী? অরুণাভ ঘোষ বললেন, ‘‘বিধায়করা মূলত চাইছেন দুটো জিনিস— এক, নিজের নিজের এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখা, যেটা শাসক দলের সঙ্গে না থাকলে মুশকিল। দুই, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা আমদানির বিষয়টা ঠিক রাখা।’’ উদাহরণ দিতেও পিছপা হননি কংগ্রেসের এই আইনজীবী নেতা। বললেন, ‘‘মানস ভুঁইয়ার কথাই ধরুন। সবং-এ জিতেছিলেন ঠিকই। কিন্তু কোনও কাজই করতে পারছিলেন না। তার উপরে আবার খুনের মামলাও ছিল। তাই তৃণমূলে চলে গেলেন। নিজে সাংসদ হয়ে গেলেন। স্ত্রীকে সবং-এর বিধায়ক বানিয়ে নিলেন। সবই লাভ-ক্ষতির অঙ্ক।’’

মানস ভুইয়াঁ ও তাঁর স্ত্রী গীতা ভুইযাঁ। দলবদলের পর দু’জনই জনপ্রতিনিধি। —ফাইল চিত্র

কিন্তু যাঁরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে কী বলবেন? তাঁরাও কি কোনও লোভে পড়ে যাচ্ছেন? অরুণাভর সুর এ বার অন্য রকম। বললেন, ‘‘বিজেপি-তে খুব বড় নেতা কেউ যাচ্ছেন না। সবই নীচের স্তরে। আমাদের এক জন জেলা সভাপতি সম্প্রতি বিজেপিতে গেলেন ঠিকই। কিন্তু মূলত যাচ্ছেন কর্মীরা।’’ কর্মীরা কেন বিজেপিকে বেছে নিচ্ছেন, কেন তৃণমূলকে নয়? অরুণাভের ব্যাখ্যা, ‘‘বহু বছর এ রাজ্যে ক্ষমতায় নেই কংগ্রেস। এর পরেও যাঁরা কংগ্রেসে রয়েছেন সাধারণ কর্মী হিসেবে, তাঁরা কেউ তো কিছু পাওয়ার আশায় নেই। তাঁরা কংগ্রেসকে ভালবাসেন বলে কংগ্রেস করছিলেন। কিন্তু দিনের পর দিন তৃণমূলের হাতে মার খাওয়াটাও মেনে নিতে পারছেন না এই কর্মীরা। তাঁরা বুঝছেন যে, কংগ্রেস বা সিপিএম তৃণমূলকে পাল্টা মারে পারবে না। পারলে বিজেপি-ই পারবে, কারণ কেন্দ্রে তাঁরা ক্ষমতায়। সেই কারণেই তাঁরা বিজেপিতে যাচ্ছেন।’’

২০১৪ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছিলেন জয়প্রকাশ মজুমদার। তাঁর কথা প্রায় হুবহু মিলে গেল অরুণাভর কথার সঙ্গে। বললেন, ‘‘সবাই মানস ভুইঁয়া বা অপূর্ব সরকার বা রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় নন। মেরুদণ্ড রয়েছে অনেকেরই। তাঁরা আত্মসমর্পণ করছেন না। লড়তে চাইছেন। আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র মঞ্চ এখন বিজেপি।’’ জয়প্রকাশ অবশ্য বলছেন, শুধু কংগ্রেস নয়, বামদলগুলি থেকেও অনেকেই বিজেপি যোগ দিচ্ছেন। বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘সিপিএম তো নারকেলের মতো, উপরের খোলাটা খুব শক্ত, ভিতরে জল। কমরেড বলে ডাকা আর লাল সেলাম দেওয়ার বহু বছরের অভ্যাস নেতারা কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দল শেষ। নীচের তলা পুরো খালি হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।’’

অরুণাভ বা জয়প্রকাশদের এই ব্যাখ্যাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য পুরোপুরি মানছেন না। তাঁরা বলছেন, এই ব্যাখ্যা অনেকটাই সত্য। কিন্তু অন্য কিছু ‘ফ্যাক্টর’ও কাজ করছে। কী সেই ‘ফ্যাক্টর’? বিশ্লেষকদের মতে, মেরুকরণের রাজনীতিও বেশ খানিকটা প্রভাব ফেলছে ভাঙনে। বিজেপি কৌশলে কট্টরবাদের সুর চড়াচ্ছে। তৃণমূল তত বেশি করে সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছে। কংগ্রেস এবং বামেরা এই লড়াইয়ে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে রাজ্যে তাদের শক্তিহীনতার কারণেই। ফলে সংখ্যালঘুদের বড় অংশ তৃণমূলে সামিল হয়ে যাচ্ছেন। আর গেরুয়া কট্টরবাদের সমর্থকরা বিজেপি-র দিকে চলে যাচ্ছেন। মহেশতলা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফলেও সেই মেরুকরণের ইঙ্গিত রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের একাংশের মত।

কিন্তু এই ভাঙন ঠেকানোর উপায় কী? কংগ্রেস কি আদৌ কোনও প্রতিরোধ কৌশল নিয়েছে? নাকি অসহায় দর্শক হয়েই থাকছে? কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র এ প্রশ্নের সোজা জবাব দিলেন না। কংগ্রেসের কোনও প্রতিরোধ কৌশল রয়েছে কি না, সে প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন তিনি। বললেন, ‘‘ভাঙন হচ্ছে জানি। কিন্তু শুধু নেতারা যাচ্ছেন, সঙ্গে খুব বেশি অনুগামীকে তাঁরা নিয়ে যেতে পারছেন না। আর এঁরা সব স্বার্থপরায়ণ রাজনীতিক। এঁরা গেলেও দলের কোনও ক্ষতি নেই।’’ কিন্তু শুধু নেতারা যাচ্ছেন, এমন কথা কি ঠিক? বিজেপিতে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা মূলত নীচের তলারই। ওমপ্রকাশ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, নীচের তলা থেকে অনেকে বিজেপিতে যাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু তাতে কংগ্রেস শেষ হবে না। ৪৫ বছর আমরা এ রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। তা সত্ত্বেও এত মানুষ এখনও কংগ্রেস করেন। এটা সাময়িক সমস্যা। মিটে যাবে।’’ আর অরুণাভ ঘোষ বলছেন, ‘‘কেন্দ্রে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফিরতে দিন। যাঁরা ছেড়ে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ফিরে আসবেন।’’

Exodus Indian National Congress BJP TMC PCC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy