Advertisement
E-Paper

ব্রেন ডেথেও নাছোড়, বিতর্কে দামি চিকিৎসা

স্বামীর বয়স ৯০। স্ত্রী-র ৮২। দু’জনেই চিকিৎসক। সম্প্রতি স্ত্রীর মৃত্যু এবং ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া অবস্থাতেই একটি ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি পুরনো বিতর্ককে ফের উস্কে দিল। রোগের কোন পর্যায়ে পৌঁছে দামি চিকিৎসা ‘অর্থহীন’ হয়ে পড়ে, কখনই বা ‘আর কিছু হওয়ার নেই’ বুঝে গিয়ে ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়াটাই নৈতিকতা, সে নিয়ে মতবিরোধ বরাবরের।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৬ ২০:৪১

স্বামীর বয়স ৯০। স্ত্রী-র ৮২। দু’জনেই চিকিৎসক। সম্প্রতি স্ত্রীর মৃত্যু এবং ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া অবস্থাতেই একটি ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি পুরনো বিতর্ককে ফের উস্কে দিল।

রোগের কোন পর্যায়ে পৌঁছে দামি চিকিৎসা ‘অর্থহীন’ হয়ে পড়ে, কখনই বা ‘আর কিছু হওয়ার নেই’ বুঝে গিয়ে ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়াটাই নৈতিকতা, সে নিয়ে মতবিরোধ বরাবরের। এক দল চিকিৎসক মনে করেন, আক্ষরিক অর্থেই ‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ’। তাই রোগীর শেষ নিঃশ্বাস না পড়া পর্যন্ত সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী তাঁরা। অন্য পক্ষের বক্তব্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন ইঙ্গিত দিচ্ছে কোনও রকম উন্নতির আশা নেই, তখন রোগীকে ধনেপ্রাণে না মারাই শ্রেয়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রী-রোগ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক-চিকিৎসক হিমাংশুশেখর জানার বক্তব্য, তিনি দ্বিতীয় মতটিকেই আগাগোড়া অনুসরণ করে এসেছেন। তাঁর স্ত্রী নীলাক্ষী জানা ছিলেন আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাস্থেশিওলজি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক-চিকিৎসক। গত সেপ্টেম্বরে সেরিব্রাল হেমারেজের শিকার হন নীলাক্ষীদেবী। তাঁকে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁর মস্তিষ্কে ভেন্ট্রিকুলোস্টমি নামে একটি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও জমা দিতে বলা হয়।

হাসপাতাল সূত্রে খবর, যখন অস্ত্রোপচার হয়, তখনই নীলাক্ষীদেবীর ব্রেন ডেথ হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচারের দু’দিন পরেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

হিমাংশুবাবু জানিয়েছেন, একাধিক স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞ তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর স্ত্রীর ওই শারীরিক পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচার করার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কারণ এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে কোনও ফলই মেলার কথা নয়। হিমাংশুবাবুর প্রশ্ন, ‘‘অস্ত্রোপচারের জন্য যা খরচ হয়েছে সে নিয়ে আমার বা আমার সন্তানের কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন, একজন রোগিণীর ব্রেন ডেথ হয়েছে জানার পরেও কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল?’’

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই তিনি স্বাস্থ্য দফতরের দ্বারস্থ হয়েছেন। দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল এমন কী খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।

হিমাংশুবাবুর এই প্রশ্ন তাঁর একার নয়। এমন একাধিক অভিযোগ রয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল, এমন কী স্বাস্থ্য দফতরেও। ৯০ পেরনো এক বৃদ্ধের মস্তিষ্কে জটিল অস্ত্রোপচার করে অভিযোগের মুখে পড়েছিলেন বাইপাসের এক হাসপাতালের চিকিৎসক। অস্ত্রোপচারের টেবিলেই ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল। মেডিক্যাল কাউন্সিল ওই চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে ছ’মাসের জন্য তাঁর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে। আবার ব্রেন ডেথ হওয়া এক রোগীর হার্টের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে বলে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করেছেন সংশ্লিষ্ট রোগীর পরিবার। সেই মামলার শুনানি চলছে।

অন্য দিকে, কোমায় চলে যাওয়া এক প্রৌঢ়ের মস্তিষ্কে ব্যয়বহুল একটি অস্ত্রোপচার করে গোড়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন আলিপুরের এক হাসপাতালের চিকিৎসক। মাস তিনেক পরে কোমায় থাকা সেই প্রৌঢ়ের যখন চেতনা ফিরল, তখন অবশ্য বাড়ির লোকজন স্বীকার করে নেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়িই হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন।

বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, কোন পরিস্থিতিতে জটিল অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা আর কাজে আসবে না, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া সম্ভব সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পক্ষেই। সে ক্ষেত্রে শুধু শুধু পরিবারের অর্থ ব্যয় এবং রোগীর ভোগান্তি না বাড়িয়ে প্রকৃত পরিস্থিতিটা পরিবারের লোকের কাছে তুলে ধরাটাই যুক্তিযুক্ত। সব জানার পরেও যদি পরিবারের লোকেরা সেটা চান, তা হলেই একমাত্র ওই চিকিৎসা

করা উচিত। আর অন্য মত হল, ‘মিরাকল’ বলেও একটা শব্দ রয়েছে। সব সময়ে চিকিৎসককে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে এর পর অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। ফলে ক্ষতিটা হবে রোগীরই।

হিমাংশুবাবুর বিষয়টি নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই লড়াই শুরু করেছে রোগী স্বার্থে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ওই সংগঠনের সভাপতি, চিকিৎসক কুণাল সাহা বলেন, ‘‘একে ৮২ বছর বয়স, তার ওপর ব্রেন ডেথ। এ ক্ষেত্রে কোনও ধন্দ থাকার কথাই নয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে কোন পরিস্থিতিতে রোগীকে অপারেশন টেবিলে তোলা হয়েছিল।’’

বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক মহল দ্বিধাবিভক্ত। রাজ্য স্ট্রোক ফাউন্ডেশনের সভাপতি দীপেশ মণ্ডল জানিয়েছেন, ৮০ পেরনো রোগীর ক্ষেত্রে তাঁরা কখনওই এই ধরনের অস্ত্রোপচারের পক্ষে নন। স্নায়ু চিকিৎসক তৃষিত রায়ও জানান, এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার না করাই শ্রেয় ছিল।

আবার স্নায়ু শল্য চিকিৎসক শ্যামাপদ গড়াই বা সুজয় সান্যালের বক্তব্য, ‘‘অস্ত্রোপচার করে ফল হবে কি না, সেটা একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম। নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।’’

যে স্নায়ু শল্য চিকিৎসক নীলাক্ষিদেবীর অস্ত্রোপচার করেছেন, সেই দিব্যেন্দু রায় স্বীকার করেছেন যে, নীলাক্ষীদেবীর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত যখন হয় ততক্ষণে ওঁর

ব্রেন ডেথ হয়ে গিয়েছে। তাঁর দাবি, ‘‘রোগীর বাড়ির লোকেরা এর আগে অন্য ডাক্তারের মাধ্যমে যাবতীয় ওষুধপত্র প্রয়োগ করে সব রকম চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। একেবারে শেষ চেষ্টা হিসেবে বাড়ির লোকের অনুমতি নিয়েই এটা করা হয়েছিল।’’

হিমাংশুবাবু অনুমতিপত্রে সই করার কথা মেনে নিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘রোগীর ওই পরিস্থিতিতে কোনও ডাক্তার যদি বাড়ির লোকের কাছে এমন প্রস্তাব দেন, তা হলে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে তাঁরা ডাক্তারের কথাটাকেই মেনে নেন। নিউরোলজির ক্ষেত্রে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই। তাই সংশ্লিষ্ট ডাক্তার যা বলেছেন সেটাই মেনেছি। প্রকৃত পরিস্থিতি জানলে কখনওই রাজি হতাম না।’’

brain death soma mukhopadhyay nilakkhi jana
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy