ছেলের কফিনের সামনে মা শিখাদেবী। ছবি: সুব্রত জানা।
কফিনের নম্বর ৪২৯৪৮২৮ এক্স।
এতক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় পতাকায় মোড়া ছিল সেটি। চিতায় তোলার আগে কফিন খুলে ভিতর থেকে বের করা হল দেহ। অতি সন্তর্পণে উর্দি পরা চার জওয়ান যে জিনিসটি বের করলেন তা গোটা দেহ নয়, রক্তমাখা একটা কাপড়ের পুঁটলি। যা বুঝিয়ে দেয় কত যন্ত্রণা নিয়ে শহিদ হয়েছেন ২২ বছরের তরুণ গঙ্গাধর দলুই।
ঘরের ছেলেকে চিরবিদায় জানাতে ভেঙে পড়েছিল গোটা গ্রাম। কখন দেহ এসে পৌঁছবে, রাতভর তারই অপেক্ষায় ছিল যমুনাবালিয়া। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা। সেনাবাহিনীর বিশেষ কনভয়ে চেপে গ্রামে ঢুকল গঙ্গাধরের দেহ। সঙ্গে বিহার রেজিমেন্টের সেনাকর্তারা। আগে থেকে হাজির ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায় এবং সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এসেছিলেন হাওড়ার জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাস, গ্রামীণ জেলা পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন-সহ রাজ্য পুলিশের কর্তারা। ছিলেন আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্র।
বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার নিহত জওয়ান গঙ্গাধর দলুইয়ের জগৎবল্লভপুরের বাড়িতে যায়। পরে সুভাষবাবু বলেন, ‘‘গঙ্গাধরের বাড়ির জীর্ণ দশা। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকায় ওঁদের পরিবারের নাম রয়েছে। কিন্তু তাজঁরা এখনও বাড়ি পাননি। আমি স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের বলেছি, তাঁরা যেন এ ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যাতে গঙ্গাধরের পরিবার বাড়িটা দ্রুত পান।’’
এ দিন মরদেহ গ্রামে আনা থেকে শেষকৃত্যের পুরো দায়িত্ব সেনাবাহিনী তুলে নেয় নিজের হাতে। প্রথমে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গাধরের বাড়িতে। সেখানে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। বাড়ির সামনে একটি বেঞ্চে কফিন নামানোর পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না বাবা ওঙ্কারনাথ। ছেলের কফিন ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কেঁদে উঠল গোটা গ্রাম। কোনওমতে বাবাকে সামলাল ছোট ছেলে বরুণ। বাবা তো দেখলেন, কিন্তু মা!
ছেলের অপেক্ষায় রাতে ঘুমোননি শিখাদেবী। ছেলেকে দেখার জন্য ডাকতে গ্রামেরই একজন ভিতরে গিয়েছিলেন। এসে জানালেন, বাইরে আসার সাধ্য নেই তাঁর। ছেলের দেহ যেন ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘর বলতে দু’কামরার কুঁড়ে। পাশাপাশি দু’জন ঢোকা কঠিন। কিন্তু মায়ের আদেশ বলে কথা। অপরিসর দরজা দিয়েই ৬ ফুট লম্বা কফিন কাঁধে ঘরে ঢুকলেন চার জওয়ান। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের আর্তি, ‘‘কফিন খোল। ছেলের মুখ দেখব।’’ কিন্তু সন্তানহারা মায়ের এই আর্তিতে সাড়া দিতে পারলেন না জওয়ানেরা। ছেলের বিকৃত দেহ কী করে দেখাবেন মাকে? মায়ের কান্নার মধ্যেই চার জওয়ানের কাঁধে চেপে গঙ্গাধরের কফিনবন্দি দেহ চলল এক কিলোমিটার দূরের শ্মশানে। রাস্তার দুধারে সার বেঁধে থাকা মানুষ চোখের জল মুছছেন। কেউ দৌড়লেন শবমিছিলের পিছনে। শ্মশানে যখন দেহ পৌঁছলো সেখানে তখন জনারণ্য।
বিশেষভাবে তৈরি বেদিতে রাখা হল জাতীয় পতাকায় মোড়া কফিন। দেওয়া হল সেনাবাহিনী, রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের তরফে গার্ড অফ অনার। বেজে উঠল বিউগল। একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন দুই মন্ত্রী, জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, সামরিক বাহিনীর কর্তারা। চিতায় তোলা হল গঙ্গাধরের দেহ। মুখাগ্নি করল ভাই বরুণ। জ্বলে উঠল চিতা। গান স্যালুটের শব্দ ছাপিয়ে ফের শোনা গেল বাবার কান্না। কেঁদে উঠলেন গ্রামবাসীরাও। ঘড়িতে তখন সকাল পৌনে সাতটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy