ধীরে ধীরে নিয়ম বদলাচ্ছে আম-রাজত্বে।
এত দিন ধরে আমের ফলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি শব্দবন্ধ— অফ ইয়ার ও অন ইয়ার। বেশি ফলনের বছরকে ‘অন ইয়ার’ বলেন চাষিরা। একই ভাবে কম ফলনের বছরকে বলা হয় ‘অফ ইয়ার’। সাধারণত কোনও বছরে কোনও জেলায় যদি আম বেশি ফলে, তা হলে পরের বছর সেখানে উৎপাদন কমে যায়। দীর্ঘদিন ধরে আম-রাজত্বে এমনটাই চলে আসছে। সে মুর্শিদাবাদ-মালদহই হোক বা নদিয়া-দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
সেই নিয়মে এখন বদল দেখতে পাচ্ছেন রাজ্যবাসী। তাই গত মরসুমে আমের মারকাটারি ফলনের পরেও এ বছর চাষিদের আশা, আবার ঝুড়ি উপচে পড়বে।
ইলিশের মতো আমও খাদ্যরসিক বাঙালির অত্যন্ত প্রিয়। মরসুমে ইলিশের মতোই আমের জন্যও হাঁ করে চেয়ে থাকে মানুষ। বাজারে গিয়ে বেছে বেছে হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোলাপখাস, বেগমপসন্দের মতো আম কেনা এবং তা নিয়ে তর্কবিতর্কে অনেকেরই জুড়ি নেই। ছোট ইলিশ যেমন খাবার পাতে ব্রাত্য, আমের মধ্যে ফজলিও তেমনই। আবার ইলিশের মতো আম-উৎসবও এখন মরসুমের অঙ্গ।
এত দিন ‘অফ ইয়ারে’ এই আনন্দ অনেকটা ফিকে হয়ে যেত। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এক বছর ফলন দেওয়ার পরে আম গাছ ‘কাহিল’ হয়ে পড়ে। তাই পরের বছর তাতে ফলন হয় কম। গত প্রায় এক দশক ধরে কিন্তু এই নিয়মটা ঘুরিয়ে দিয়েছে মালদহ জেলা। আম-রসিকদের মতে, মালদহের আম মানের দিক থেকে খুব উঁচু নয়। কিন্তু পরীক্ষানিরীক্ষায় তারাই বিপ্লব ঘটিয়েছে। কী রকম?
এ বছর মালদহে ছিল ‘অফ ইয়ার’। গত বছর ‘অন ইয়ার’-এ চার লক্ষ মেট্রিক টন আম ফলেছে এই জেলায়। এ বার হিসেবমতো তাই ফলন কম হওয়ার কথা। কিন্তু এ বার যে ভাবে গাছ ভরে আম এসেছে, তাতে চাষিরা মনে করছেন, ফলন সাড়ে তিন লক্ষে পৌঁছে যাবে।
এতটা না হলেও এই হাওয়া ভাগীরথী পেরিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে মুর্শিদাবাদেও। সেখানে এ বারে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ফলনের। কালবৈশাখীতে কিছু আম নষ্ট হয়েছে। তা-ও আশায় আছেন চাষিরা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা নদিয়ার বিভিন্ন অংশেও আমের বোল এ বার ভাল।
কেন এই পরিবর্তন? কৃষি বিজ্ঞানী তথা আম বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পিছনে রয়েছে মূলত দু’টি কারণ। প্রথমত, চাষিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। এখন তাঁরা অনেক আগে থেকে নিয়ম মেনে সার দিচ্ছেন, কীটনাশক ছড়াচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, মালদহে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি। উদ্যান পালন দফতরের সহ-অধিকর্তা রাহুল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলার ৬০ % জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছে। অক্টোবরেই বাগানে জলসেচ করছেন চাষিরা।’’ মোহনপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আম বিশেষজ্ঞ বিকাশ ঘোষ বলেন, ‘‘মালদহ ‘প্যাকলোবুট্রাজোল’ নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করে, যাতে ফলন বাড়ে।’’
এই ব্যাখ্যা মেনে নিচ্ছেন লালবাগের আমচাষি হায়াতুন নবীও। উদ্যানপালন বিভাগের শীর্ষে রয়েছেন তিনি। মুর্শিদাবাদ কুলীন আমের জায়গা। তাই স্বাদ নষ্টের ভয়ে এখানকার চাষিরা রাসায়নিকের বদলে জৈব সার ব্যবহার করেন। হায়াতুনের কথায়, ‘‘এর উপরে আম্রপালি, মল্লিকার মতো সঙ্কর প্রজাতির আমচাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় অফ আর অন ইয়ারের ফারাকও কমে আসছে।’’ একই কারণে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গাতেও ফলন যথেষ্ট বেড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এ বারের আবহাওয়া। বসিরহাটের সফিকুল মণ্ডলের মতে, সব মিলিয়েই আম ফলনে জোয়ার আসার সম্ভাবনা এ বারে।
এই ফলনে ভর করে আম রফতানির উপরে জোর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু মালদহের মতো সাফল্য অন্য জেলাগুলো ধরে রাখতে পারবে কি? ‘‘আসছে বছরটা দেখুন,’’ বলছেন ভাগীরথীর দক্ষিণ পাড়ের চাষিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy