Advertisement
০১ মে ২০২৪

‘দানা ভরবে’ ছেলে, সুপারি দিয়ে খুন ছেলেকেই

সাকুল্যে আড়াই বিঘা জমি। বসিরহাটের অদূরে সম্বৎসর ফলন দেওয়া মেরুদন্ডি গ্রামের সেই ধানি জমিটুকু হাতিয়ে নিতে প্রায়ই বাবাকে ‘পেটে দানা (গুলি) ভরে’ লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি দিত বড় ছেলে বাবলু। বছর দুয়েক ধরে নিজের ছেলের মুখে ক্রমাগত খুনের শাসানিতে তটস্থ হয়ে, বাবা সোহরাব সর্দার তাই মরিয়া হয়ে ছেলেকেই পাল্টা খুনের ছক কষেছিল।

বাবলু সর্দার।— নিজস্ব চিত্র।

বাবলু সর্দার।— নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

সাকুল্যে আড়াই বিঘা জমি। বসিরহাটের অদূরে সম্বৎসর ফলন দেওয়া মেরুদন্ডি গ্রামের সেই ধানি জমিটুকু হাতিয়ে নিতে প্রায়ই বাবাকে ‘পেটে দানা (গুলি) ভরে’ লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি দিত বড় ছেলে বাবলু।

বছর দুয়েক ধরে নিজের ছেলের মুখে ক্রমাগত খুনের শাসানিতে তটস্থ হয়ে, বাবা সোহরাব সর্দার তাই মরিয়া হয়ে ছেলেকেই পাল্টা খুনের ছক কষেছিল।

পুলিশের জেরার মুখে মেরুদন্ডির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা, ষাট ছুঁই ছুঁই সোহরাব কবুলও করেছে— সে কাজে, জামাই মনিরুলের সঙ্গে শলা করে ভাড়াটে খুনি মফিজুলকে দায়িত্বও সঁপে দেওয়া হয়েছিল। চুক্তি ছিল, কাজ ‘হাসিল’ হলেই হাতে হাতে মিলবে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা।

আপাত নিরীহ চেহারার ইটভাটার শ্রমিক ওই প্রৌঢ় যে, এ ভাবে ছেলেকে নিকেষ করতে ‘সুপারি’ দিতে পারে, দুঁদে পুলিশ অফিসারেরাও প্রথমে তা ভাবতে পারেননি। পক্ষকাল গড়িয়ে গেলেও তাই বাবলু-খুনের কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা।

বুধবার সেই খুনেরই শেষতক জাল গুটিয়ে এনেছেন তদন্তকারীরা। এ দিন গ্রামের বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে, পুত্র-হন্তায় জড়িতে বাবা সোহরাব, তার জামাই মনিরুল এবং ভাড়াটে খুনি মফিজুলকে।

বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের প্রায় ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল। তিন জনের কথাতেই ফাঁক ছিল। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না।’’ তিনি জানান, এ দিন মফিজুল এবং মনিরুলকে পাশাপাশি বসিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে জেরায় শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে তারা। তাদের কথার সূত্র ধরেই গ্রেফতার করা হয়েছে সোহরাবকে। আজ, বৃহস্পতিবার তাদের বসিরহাট আদালতে তোলা হবে।

তবে, ভাঙলেও মচকাচ্ছে না সোহরাব। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, এ দিন থানায় বসে ভাড়াটে খুনি মফিজুলের আক্ষেপ ছিল, ‘কাজ হাসিল’ করলেও চুক্তির ২৫ হাজার টাকার ছিটোফোঁটা পায়নি সে। যা শুনে পাশ থেকে সোহরাব তাকে আশ্বস্ত করে, ‘‘অত চিন্তা কোরো না। ছাড়া যদি পাই, তোমার পাওনা ঠিক মিটিয়ে দেব।’’

বসিরহাট থানার তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সেই কাজ হাসিল হয়েছিল গত ৩০ মে।

গ্রামেগঞ্জে ছিঁচকে চুরিতে হাত পাকানো মফিজুল বাবলুদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ছোটখাটো অপরাধে বছর আঠাশের বাবলুর সঙ্গে বেশ কয়েক বার সঙ্গীও হয়েছে সে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। তবে বছর পাঁচেক মুম্বইয়ে কাটিয়ে গ্রামে ফেরার পর বাবলুর ‘স্বভাব’ খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে মহিজুল। পুলিশের কাছে তার অভিযোগ ‘চাল চলন, হাবভাব’ অনেকটা ‘মুম্বইয়ের মাফিয়াদের’ মতো হয়ে গিয়েছিল তার। বেড়ে গিয়েছিল টাকার খাঁই, দুর্ব্যবহারও।

সোহরাবের কথামতো মনিরুল প্রস্তাবটা দিতেই তাই লুফে নিয়েছিল মফিজুল। পুলিশকে সে জানায়, ‘‘পঁচিশ হাজার টাকা কী মুখের কথা, লোভে পড়ে গিয়েছিলাম তাই।’’

এ দিন পুলিশকে সে জানায়, গ্রামের অদূরে নির্জন রাংড়া মাঠে স্যালো মেশিন চুরির জন্য বাড়ি থেকে বাবলুকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সে। সেখানে, মেশিনের নাট-বল্টু খোলার সময়ে বাবলুর মাথায় রডের বাড়ি মেরে কাজ হাসিল করে সে। বাবলু পড়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত কাস্তে দিয়ে তার গলার নলিও কেটে দেয় সে।

পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘বাবলুর বিরুদ্ধেও থানায় বেশ কিছু অভিয়োগ ছিল। তদন্তে নেমে কিছুতেই তাই বোঝা যাচ্ছিল না কে বা কারা এই কাজ করল।’’ এলাকার বেশ কয়েক জন সমাজবিরোধীকে আটক করে পুলিশ। সেই তালিকায় মফিজুলও ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ওই দিন সন্ধ্যায় সে ভাগ্নির বিষ খাওয়ার খবর পেয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। পুলিশকেও তেমনই জানিয়েছিল সে।

তবে অন্ধকারে হাতড়ানোর সময়ে আচমকাই অন্য এক সমাজবিরোধী পুলিশকে জানায়, ওই দিন রাতে একটি খুনের ‘বরাত’ পেয়েছিল মফিজুল। সঙ্গী হলে তাকে ১০ হাজার টাকা দেবে বলেও টোপ দিয়েছিল সে।

পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তারপরেই নতুন করে জেরা শুরু করা হয় মফিজুলকে। আর তাতেই শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে সে।’’ কবুল করে বাবলুকে খুন করেছে সে।

এর পরে মনিরুলকে পাসে বসিয়ে জেরা করতেই বেরিয়ে পড়ে সোহরাবের নাম।

পুলিশ জানায়, থানায় এসে পুলিশের জেরার কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল সে। তারপর, বলে, ‘‘ছেলেটা বড় বেয়াড়া হয়ে উঠেছিল। মুম্বই থেকে ফিরে জমি হাতানোর পর প্রায়ই পেটে দানা ভরে খুন করার হুমকি দিত। আমি সংসারের জন্য দিনরাত ইটভাঁটায় পরিশ্রম করতাম। এই ভাবে বাঁচা সম্ভব নয় বলেই ছেলেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।’’ শ্বশুরের কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছেন মনিরুলও।

এ দিন বিকেলে তাদের গ্রেফতারের পরে, খাঁ খাঁ বাড়িতে পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করছিলেন দু’জন— বাবলু আর মনিরুলের দুই অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রুবিয়া আর জ্যোৎস্না বিবি—‘‘হায় গো কী নসিব, এটাও দেখতে হল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE