Advertisement
E-Paper

ছ’মাসেও খোলেনি বিষ্ণুপুরের ফেরো অ্যালয় কারখানা

ডিসেম্বরের একটা রাত বদলে দিয়েছে তাঁদের জীবন। সেই রাতেই তাঁরা হয়েছিলেন রুজিহীন! রাতারাতি কাজ হারানো এক ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল তাঁদের জীবন। তাঁরা, বিষ্ণুপুর থানার দ্বারিকা শিল্পাঞ্চলের ‘শ্রী বাসবী ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে ফেরো অ্যালয় কারখানার শ্রমিক। অথচ ছ’মাস আগেও জীবনটা অন্য রকম ছিল তাঁদের। সময় মতো কাজে যেতেন কারখানায়।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৩:৫৮
কারখানার কাজ নেই। কেউ চাষজমিতে কাজ করছেন।

কারখানার কাজ নেই। কেউ চাষজমিতে কাজ করছেন।

ডিসেম্বরের একটা রাত বদলে দিয়েছে তাঁদের জীবন। সেই রাতেই তাঁরা হয়েছিলেন রুজিহীন! রাতারাতি কাজ হারানো এক ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল তাঁদের জীবন।

তাঁরা, বিষ্ণুপুর থানার দ্বারিকা শিল্পাঞ্চলের ‘শ্রী বাসবী ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে ফেরো অ্যালয় কারখানার শ্রমিক। অথচ ছ’মাস আগেও জীবনটা অন্য রকম ছিল তাঁদের। সময় মতো কাজে যেতেন কারখানায়। কারও কাজ মালপত্র প্যাকিং, লোডিং-আনলোডিং, তো কারও দায়িত্ব প্রোডাকশনে। মাসের শেষে বাঁধা আয় হাজার ছয়েক। তাতেই নিম্নবিত্তের সংসার চলে যাচ্ছিল। খড়ের ছাউনি বদলে কেউ কেউ নিজের মাটির বাড়িতে বসাচ্ছিলেন টিন বা অ্যাসবেস্টস। কাঁচা বাড়ি আস্তে আস্তে পাকাও করছিলেন কেউ কেউ। স্বপ্ন দেখছিলেন আরও একটু স্বচ্ছলতার।

কিন্তু, সব বদলে দিল গত ১৫ ডিসেম্বরের রাত। সে রাতেই নিরাপত্তারক্ষীদের রাতের ডিউটিতে আসা শ্রমিকদের বের করে দিয়ে কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল মালিকপক্ষ। গেটে পড়ে গেল কারখানা বন্ধের নোটিস। তার পর অনেক আন্দোলন হল। কারখানা খোলা নিয়ে সরকারি স্তরে আলাপ-আলোচনাও কম হল না। কিন্তু সব পণ্ড। দেখতে দেখতে ছ’মাস পার। এই সময়ের মধ্যে কর্মহীন শ্রমিকদের অধিকাংশই বিকল্প রুজির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ ভ্যান রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ করছেন রাজমিস্ত্রির কাজ, কেউ আবার সব্জি বিক্রি করে সংসার টানার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। বেকারত্ব সহ্য করতে না পেরে ওই কারখানার এক শ্রমিক নীলু আইচ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতীও হয়েছেন কিছুদিন আগে। দ্বারিকা গ্রামে ২০০০ সালে এই ফেরো অ্যালয় কারখানাটি গড়ে উঠেছিল। কাজ পেয়েছিলেন এলাকার প্রায় ৮০০ শ্রমিক। নীলুর মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা গ্রামকেই।

কেউ বা সংসার চালাতে রিকশা চালাচ্ছেন।

কারখানার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে বিষ্ণুপুর-সোনামুখী রাজ্য সড়ক। সেই রাস্তার পাশেই একটি পুরনো সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছেন বন্ধ কারখানার শ্রমিক রঞ্জিত মজুমদার। বললেন, “সংসার টানাই এখন দায় হয়ে উঠেছে। যত দিন কারখানা চলেছে, মাসে ৬ হাজার টাকা ছিল বাঁধা আয়। এক ছেলেকে নিয়ে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর তিন জনের সংসার। ছ’মাস হয়ে গেল কারখানা খোলার নামগন্ধ নেই। আমাদের পাওনা টাকা-পয়সাও দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। বাধ্য হয়ে বাড়ির পুরনো মেশিনটা নিয়ে ছেঁড়া-ফাটা সেলাই করতে নেমেছি। সারা দিনে কখনও কখনও ২০-২৫ টাকাও হয় না। এতে কি সংসার চলে?”

দ্বারিকা গ্রামেই একটি ভাড়ার রিকশা চালাচ্ছেন তরুণ বাগদি। তাঁর ক্ষোভ, “১৪ বছর ওই কারখানা আমার সব চুষে নিয়েছে! পাওনা-গন্ডা কিছু না মিটিয়েই তাড়িয়ে দিল। শরীর আর চলছে না। ঘরে পাঁচটা পেট। বাধ্য হয়ে তিন চাকার প্যাডেলে পা চালাতে হচ্ছে। পেনশন-গ্র্যাচুইটির জমা টাকাগুলো কবে পাব, বলতে পারেন?” উত্তর ছিল না। কিন্তু, একই প্রশ্ন উড়ে এল কারখানার কাছে একটি হোটেলে কাজ নেওয়া শ্রমিক শেখ আমীরের গলায়। তিনি বলেন, “ওই কারখানায় মালপত্র প্যাকিংয়ের কাজ ছিল আমার। হাজার ছয়েক টাকা মাসে আসত। এখন ১৩০ টাকা রোজে কাজ করতে হচ্ছে। এতে সংসার চলে? পাওনা টাকাগুলো দেওয়ার কথা ছিল। তা-ও তো দিল না! কবে দেবে আপনারা বলতে পারবেন?”

হোটেলেও কাজ নিয়েছেন কেউ।

এলাকাতেই পানের গুমটি করে বসা সুনীল বাগদীর গলাতেও ঝরে পড়ল ক্ষোভ। বললেন, “জমি-জায়গা কিছু নেই। দুই প্রতিবন্ধী ছেলে ও এক মেয়েকে কষ্ট করেও পড়াচ্ছি। পানের দোকানের সামান্য আয়ে ক-দিন টানতে পারবো জানিনা। কারখানায় কাজের সময় মাটির ঘরে খড় সরিয়ে টিনের চালা লাগিয়েছিলাম। এখন ঝড়ে উড়লেও মেরামতির টাকা নেই। বকেয়া বেতন ও অন্যান্য পাওনা টাকা না দিয়েই কোম্পানি চলে গেল। আদৌ আর খুলবে কিনা, জানি না। পাওনা টাকাগুলো অন্তত পেলে অন্য কিছু ব্যবসার কথা ভাবতে পারি।’’ রাস্তায় লটারি নিয়ে বসা শেখ মিলন বা কোদাল নিয়ে চাষজমিতে মাটি কাটার কাজে নামা দুর্গা বাগদিরও প্রশ্ন, “দাদা কোম্পানিটা খুলবে তো? না হলে পাওনা টাকাগুলোর কিছু ব্যবস্থা করা যাবে?” রাস্তায় রেডিমেড পোশাক নিয়ে বসা শেখ বাদলের আক্ষেপ, “সবে বাড়িটা পাকা করতে শুরু করেছিলাম। ঢালাইয়ের কাজ বাকি পড়ে আছে। পাওনা টাকাগুলো পেলে শেষ করতে পারব। কিন্তু কবে দেবে, কিছুই জানি না।”

কর্মহীনদের সামনে দাঁড়ালেই ঘুরেফিরে উড়ে আসছে একই প্রশ্ন। যার উত্তর জানে না প্রশাসনও। বিষ্ণুপুরের সহকারী শ্রম কমিশনার সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “কথা রাখেনি মালিকপক্ষ। আমরা ওদের সঙ্গে ফের বসার চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ কলকাতা থেকে ফিরে সম্প্রতি আত্মঘাতী শ্রমিকের বাড়িতে শোক জানাতে গিয়েছিলেন এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “মৃত নীলু আইচের স্ত্রী-র অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের প্রাপ্য পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ফের প্রশাসনিক বৈঠকের ভাবনা-চিন্তা চলছে।’’ দেউলিগ্রামে এসে শোকার্ত পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। তিনি তাঁদের হাতে কিছু আর্থিক সাহায্যও করেন। অমিয়বাবু বলেন, “নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও পাওনা টাকা না পেয়েই এই মৃত্যুর ঘটনা। এই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসব।’’ স্থানীয় নেতৃত্বকে শ্রম দফতরের সঙ্গে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ছবিগুলি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।

Bishnupur Bankura Felo alloy sunil bagdi ranjit majumdar factory
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy