Advertisement
E-Paper

বাজি এখন কুটির শিল্প, বলছে কেন্দ্রই

আঁকাজোকা, শিল্প-কলাকে এক ধরনের শিল্প বলেই মনে করেন তিনি। বর্ধমানে এক সরকারি অনুষ্ঠানে কাঁথা-শিল্পকেও আগামী দিনের ভারী শিল্পের মযার্দা দিতে দ্বিধা করেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শিল্প-তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে তেলেভাজাও। পিংলায় বিস্ফোরণের পরে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া এখন ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হয়তো জানেন না, বারুদ-শিল্পও এখন বাংলার গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্পের চেহারা নিয়েছে!’’

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০৩:০০

আঁকাজোকা, শিল্প-কলাকে এক ধরনের শিল্প বলেই মনে করেন তিনি। বর্ধমানে এক সরকারি অনুষ্ঠানে কাঁথা-শিল্পকেও আগামী দিনের ভারী শিল্পের মযার্দা দিতে দ্বিধা করেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শিল্প-তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে তেলেভাজাও।

পিংলায় বিস্ফোরণের পরে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া এখন ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হয়তো জানেন না, বারুদ-শিল্পও এখন বাংলার গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্পের চেহারা নিয়েছে!’’

নিছকই বিরোধীদের ‘অতিরঞ্জিত অভিযোগ’ বলে বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্নে বাদ সাধছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের একটি রিপোর্ট।

ওই মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে ‘ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন’ (এনআরএলএম)-এর সাম্প্রতিক ওই রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে আতস বাজির কারবার, রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলাকে প্রায় ‘মিনি শিবকাশী’র চেহারা দিয়েছে।

সেই তালিকায় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে হুগলি, মুর্শিদাবাদ, এমনকী দুই মেদিনীপুরও। ঢাউস কারখানা নয়, আটপৌরে আর পাঁচটা গ্রামের মতোই সেই সব ‘বাজি-গ্রাম’। যেখানে সাধারণ গৃহস্থের বাড়িতে নিভৃতে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বাজি।

তবে মানসবাবুরা বলছেন, শুধু বাজি নয়, রাজ্যের আনাচ কানাচে এই কারখানাগুলি আদতে ‘বোমা তৈরির আখড়া’। পিংলার ব্রাহ্মণবাড়ে রামপদ মাইতির বাজি কারখানাটি তারই একটি উদাহরণ বলে দাবি তাঁদের।

এনআরএলএমের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যের অন্তত সাতটি জেলায় ৫৮৯টি বাজি গ্রামের খোঁজ মিলেছে! স্থানীয় পুলিশের নথিতে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। কোনও রকম হিসেব নেই স্থানীয় পঞ্চায়েতের খাতাতেও।

বুধবার রাতে পিংলার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামের যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখান থেকে কিছু দূরে তেগেরিয়া গ্রামেও বাজি কারখানার খোঁজ মিলেছে। যদিও পুলিশের দাবি, তারা এমন কোনও কারখানার কথা জানে না! স্থানীয় কুসুমদা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান গীতারানি খাড়াও নির্বিকার গলায় বলছেন, “কই জানি না তো!” শুধু পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনই নয়, রাজ্যের শ্রম দফতর এমনকী বাজি তৈরির ছাড়পত্র দেওয়ার অন্যতম সংস্থা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছেও এই ধরনের বাজি-গ্রামের কোনও খোঁজ নেই!

অথচ শব্দ বাজির দাপট রুখতে গোটা দেশকেই পথ দেখিয়েছিল এ রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদের তদানীন্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বালির একটি কারখানা ছাড়া রাজ্যের কোনও বাজি কারখানারই ট্রেড লাইসেন্স ছিল না। গত সাত বছরে পর পর কয়েকটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির ঘটনার পরে পর্ষদ তাই তৎপর হয়ে বেআইনি বাজি কারখানার খোঁজে অভিযান শুরু করেছিল।’’ তাঁর দাবি, পুলিশি অভিযান শুরু হতেই নুঙ্গি, বজবজ, নীলগঞ্জ, চন্দননগরের মতো চেনা বাজি-পাড়াগুলির রমরমা ঝিমিয়েও যায়। তবে তা সাময়িক।

তারা যে ঝাঁপ ফেলে পাকাপাকি ব্যবসা বন্ধ করেনি, ‘পরিবেশ অ্যাকাডেমি’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষায় তার সমর্থন রয়েছে। পর্ষদকে দেওয়া ওই সংগঠনের রিপোর্ট বলছে, পরিচিত এলাকা থেকে সরে গিয়ে বাজি কারখানাগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের গ্রামগুলিতে। অনেকটা কুটির শিল্পের ধাঁচে সেই সব গ্রামে বছর কয়েকের মধ্যেই ফলাও কারবার ফেঁদে বসেছিল তারা।

এনআরএলএমের রিপোর্ট বলছে— বাজি তৈরির চেনা এলাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে সাধারণ গ্রামে ছড়িয়ে পড়া ‘বাজি গ্রাম’গুলিই এখন বিভিন্ন ধরনের বাজি তৈরির আখড়া। পুলিশ এবং ক্ষমতায় থাকা শাসক দল চোখ বুজে রয়েছে। আর তাদের প্রচ্ছন্ন মদতে ব্যবসা চলছে নিশ্চুপে। যে ব্যবসায় প্রায় ‘একশো শতাংশ লাভ’ বলেই মন্তব্য করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।

বিশ্বজিৎবাবু বলছেন, ‘‘বাজি তৈরিতে যা খরচ, লাভ তার শত গুণ তো বটেই।’’

কেন?

বিশ্বজিৎবাবু জানান, বাজি গ্রামে সাধারণ মানুষকে বাজি তৈরিতে প্রশ্রয় জোগাচ্ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এ ব্যাপারে এনআরএলএমের রিপোর্ট বলছে— কোনও জেলায় ছাঁট লোহার কারবারি (হাওড়া), কোথাও বা পাট ব্যাবসায়ীরা (মুর্শিদাবাদ) ওই ব্যবসায় লগ্নি করছেন। কারণ ওই ব্যবসায়ীরা খুব ভাল করেই জানেন, দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে লাভের অঙ্ক। মুর্শিদাবাদ বা মালদহের মতো পিছিয়ে থাকা জেলা থেকে সুলভে নিয়ে আসা হচ্ছে শিশু-শ্রমিক। তাদের রোজের ‘টোপ’ দেওয়া হয় ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা। কিন্তু আদতে হয়তো হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফুলঝুরি থেকে রংমশাল, না হয় তুবড়ি— যে কোনও বাজি তৈরিতেই লাভ প্রায় একশো গুণ! অথচ কাঁচা মালের দাম থেকে নিরাপত্তার পরিকাঠামোর হ্যাপা, এমনকী সরকারি করের বোঝা— লাইসেন্স বিহীন ওই সব কারখানায় কোনও চোখ রাঙানি নেই!

কুটির শিল্পের মোড়কে তার রমরমা তা হলে ঠেকায় কে!

fire cracker industry cottage industry cottage industry disaster national rural livelihood mission
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy