Advertisement
E-Paper

পা ডুবলো না, বন্যা-দর্শন মন্ত্রীর

জল দেখলেন, পা ডোবালেন না। শোনা হল না যন্ত্রণার কথাও। অথচ অনেক কথা বলার ছিল প্রভাতি ধীবর, শিক্ষা বাগদিদের। সে কথা আর তাঁদের বলা হল না। সোমবার দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের আট গাড়ির কনভয়টি পৌঁছয় লাভপুরের থিবা গ্রামে। সঙ্গী ছিলেন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার-সহ জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০১:২৪
বুধুরা, পাড়ুই: —নিজস্ব চিত্র।

বুধুরা, পাড়ুই: —নিজস্ব চিত্র।

জল দেখলেন, পা ডোবালেন না। শোনা হল না যন্ত্রণার কথাও। অথচ অনেক কথা বলার ছিল প্রভাতি ধীবর, শিক্ষা বাগদিদের। সে কথা আর তাঁদের বলা হল না।

সোমবার দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের আট গাড়ির কনভয়টি পৌঁছয় লাভপুরের থিবা গ্রামে। সঙ্গী ছিলেন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার-সহ জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। মৎস্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, এলাকার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, এসআরডিএ চেয়ারম্যান অনুব্রত মণ্ডল প্রমুখও ছিলেন।

ঘটনা হল, লাভপুর যাওয়ার পথে ফিরহাদ পাড়ুই থানার বুধুরা গ্রামেও ঢুকেছিলেন। সেখানেও কতকটা একই ছবি দেখা যায় বলে অভিযোগ। এমনকী, দুর্গত এলাকায় যাওয়ার পরিবর্তে জেলা প্রশাসনের কর্তারা ব্যস্ত থাকলেন মন্ত্রীকে সামলাতে। বোলপুরে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সামিল হলেন বর্ধমান ডিভিশনের কমিশনার হরি রামালু, ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) রাজেশ কুমার সিংহ, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী, পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার, অতিরিক্ত জেলা শাসকেরা, মহকুমাশাসকেরা এবং একাধিক ব্লকের বিডিও, স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য কারগরি, সেচ, বিপর্যয় মোকাবিলা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রমুখ একাধিক বিভাগের আধিকারিকেরা। যা দেখে জেলার এক বিরোধী নেতা বলছেন, ‘‘ওঁরা বন্যায় দুর্ভোগে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াবেন না কি মন্ত্রীকে সামলাবেন, তা-ই ঠিক করে উঠতে পারছেন না। এ সব বৈঠক করে সময় আর অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। আসল কাজ হল মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। সেটাই তো হচ্ছে না!’’ ওই বক্তব্যের সত্যতা মিলল লাভপুরে গিয়ে।

লাভপুরে কনভয়টি এ দিন প্রথমে পৌঁছয় থিবা গ্রামের ২ নম্বর প্রাথমিক স্কুলে। সেখানে তখন একটি ঘরে মেঝেতে ঢালা রয়েছে ভাঁপ ওঠা ভাত। বালতিতে ডাল। কড়াইতে তখন রান্না হচ্ছে আলু-পোস্ত। সে সব দেখিয়েই বিগলিত হাঁসিতে প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা তথা বর্তমান তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান মন্ত্রীকে বললেন, ‘‘টানা ৯ দিন ধরেই গ্রামের মানুষকে এখানে খাওয়ানো হচ্ছে।’’ তাঁর কথা শুনেই মুখ চাওয়াচায়ি করলেন ছবি ধীবর, চিন্তা ধীবররা। এর পরেই মন্ত্রীকে নিয়ে নেতারা অদূরের কনভয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেন। কিন্তু, লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাসের অনুরোধে মন্ত্রীকে যেতে হয় ওই স্কুল লাগোয়া রাস্তার কাছে।

ওই রাস্তায় এক দিকে চলে গিয়েছে গোমস্তা পাড়া। অন্য দিকে, জল পাড়া। মন্ত্রী অবশ্য জলের ধার থেকেই ঘুরে গেলেন। কিন্তু, ওই রাস্তায় পা দিয়েই মালুম পাওয়া গেল জল-যন্ত্রণা কাকে বলে। হাঁটুর উপর পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে দু’হাতে চটি নিয়েও পাড়ায় ঢোকা যাচ্ছিল না। হাঁটুর নীচের অংশের প্যান্ট তখন জলকাদায় মাখামাখি। সংবাদমাধ্যমের এমন দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন স্থানীয় দুই যুবক। তাঁরাই একটি বাড়ির দোরগোড়ায় বাঁধা লোহার কড়াই নিয়ে এলেন। সেই কড়াইয়ে চেপেই পৌঁছনো গেল গোমস্তা পাড়ায়। যাওয়ার পথেই কড়াইয়ের লাঠির আন্দাজে বোঝা যাছিল কোথাও কোমর কোথাও বা বুক সমান জলের নীচে তলিয়ে রয়েছে রাস্তা।

খামিক এগিয়ে গোমস্তা পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল জলবন্দি হয়ে রয়েছেন সুবীর বাগদিরা চার ভাই-সহ বেশ কিছু পরিবার। চার ভাই-ই পেশায় দিনমজুর। একান্নবর্তী না হলেও এক চালাতেই রান্না হয় তাঁদের। কিন্তু, সেই চালাটি বন্যায় ভেঙে গিয়েছে। বাড়ির দাওয়া ছুয়ে রয়েছে জল। তারই মধ্যে উনুনে ভাত চাপিয়ে নাকের জল আর চোখের জল এক করছেন শিখা বাগদি, কৃষ্ণা বাগদিরা। তাঁরা বললেন, ‘‘কী করবো? এই পরিস্থিতিতে রান্না করা ছাড়া ছেলেমেয়েদের মুখে খাওয়ারটুকু তুলে দিতে পারব না। দিন তিনেক ত্রাণ শিবিরে খাওয়ার মিলেছিল। তার পরেই ওরা জানিয়ে দিয়েছে, আর খাবার মিলবে না।’’

গোমস্তা পাড়া থেকেই একই ভাবেই যেতে হল জল পাড়ায়। যেতে যেতেই চোখে পড়ল জলের নীচে তলিয়ে রয়েছে কালী মন্দির, শিব মন্দির, জলের টিউবওয়েলও। ওই পাড়ায় সাকুল্যে বারোটি পরিবারের বাস। এক সময়ে পাড়াটির নাম অবশ্য জল পাড়া ছিল না। বাগদি পাড়া হিসেবেই চিনতেন সকলে। কিন্তু, বর্ষার মরসুমে দীর্ঘ দিন জলে ড়ুবে থাকে বলেই গ্রামবাসীরা মজা করে নাম রেখেছেন জল পাড়া। ওই পাড়ার চার দিকেই ঘিরে রয়েছে কুঁয়ে নদীর জল। কিন্তু, উঁচু দ্বীপের মত জেগে রয়েছে জল পাড়া। স্থানীয় বাসিন্দা কার্তিক বাগদি, কাজল বাগদি, করুণা বাগদিরা বলেন, ‘‘আমাদের প্রতি বছর বর্ষায় এই ভাবে জলবন্দি হয়ে থাকতে হয়। বারবার প্রশাসনের কাছে অন্যত্র পুনর্বাসন চেয়েছি। কিন্তু, কোনও কাজ হয়নি। ভেবেছিলাম মন্ত্রীকে নিজদের যন্ত্রণার কথা বলব। কিন্তু, সেই সুযোগ আর পেলাম কই!’’

গ্রামের ওই স্কুল থেকে কনভয়ে চাপার মুখে মন্ত্রী স্থানীয় অভিমানী ধীবর, প্রভাতি ধীবরের সামনে পড়ে যান। মাপা হাঁসিটুকু ঠোঁটে ঝুলিয়ে ফিরহাদ তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘সব ঠিক আছে তো? ত্রাণ শিবিরে খেতে পাচ্ছেন তো?’’ অভিমানী ধীবরেরা মুখ খোলার আগেই হুস করে বেরিয়ে যায় মন্ত্রীর কনভয়। তাঁর আর শোনা হয়নি ওই সব বন্যা দুর্গতদের কথা। থামলে শুনতে পেতেন প্রভাতিদেবীরা বলছেন, ‘‘কই আর ঠিক আছি! খুব কষ্টেই দিন কাটছে। তিন দিনের পর তো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ত্রান শিবির।’’

ওই স্কুল থেকে এর পরে মন্ত্রীর কনভয় পৌঁছয় গ্রাম ঢোকার মুখে অন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে দু’ জন বন্যা দুর্গতের হাতে কেজি দু’য়েক চাল এবং সম পরিমাণ আলু তুলে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন মন্ত্রী। নিজের বক্তব্যে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই ত্রাণ বিলি এবং বন্যা পরিদর্শন করতে এসেছি। পরে রান্না সরঞ্জামের একটি কিটও দেওয়া হবে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হবে।’’ ফেরার মুখে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মন্ত্রী আরও জানান, লাভপুরের বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পরিস্থিতির মোকাবেলায় প্রশাসনের ভূমিকাও সন্তোষজনক। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য বলছেন, ‘‘মন্ত্রী ওই কথা বলতেই পারেন। কারণ, তাঁকে তো সাজানো মঞ্চে গোছানো নাটক দেখানো হল।’’

গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গিয়েছে, মন্ত্রীকে দেখাতে এ দিনই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে একই সঙ্গে পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলের পাশাপাশি কয়েক জন দুর্গতদের রান্নাও করা হয়েছিল। বিলি করার জন্য আনা হয়েছিল বস্তা বস্তা চাল আর আলু। থিবা গ্রামে ঢোকার মুখেই জলে ডুবে যাওয়া কাঁদরকুলো গ্রামে বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য এ দিন দুপুরেই ভটভটিতে চাপিয়ে আনা হয়েছিল স্পিড বোটও। কিন্তু, মন্ত্রী চলে যেতেই দেখা গেল ত্রাণ শিবির থেকে অভুক্ত অবস্থায় ফিরছেন বেশ কয়েক জন। যৎসামান্য বিলি করার পরে বস্তা বন্দি করে ত্রাণ সামগ্রী ভটভটিতে তুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তুলে নেওয়া হচ্ছে স্পিড বোটও। থিবা গ্রামের অষ্টম বাগদি, বুদ্ধদেব মণ্ডল, কাঁদরকুলোর রামকৃষ্ণ মণ্ডল, জীবন হাজরারা বলেন, ‘‘এ সব নাটক করার কোনও মানেই হয় না। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে জল যন্ত্রণা ভোগ করে আসছি। বহু নেতা-মন্ত্রীকেও দেখেছি। কিন্তু যন্ত্রণা প্রশমনে কেউ-ই উদ্যোগী হননি।’’

দুর্গতদের অভিযোগের কথা তুলতেই লাভপুরের বিডিও দাবি করেন, ধারাবাহিক ভাবে ওই ত্রাণ শিবিরে খাদ্য সামগ্রী বরাদ্দ করা হচ্ছে। ‘‘তা সত্ত্বেও কেউ যদি তা করে না থাকে, তা হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। অন্যত্র পুনর্বাসনের জন্য কেউ লিখিত ভাবে আবেদন করলে পদক্ষেপ করব,’’— বলছেন বিডিও। অন্য দিকে, বোলপুরে ফিরহাদও দাবি করেন, ‘‘প্রশাসন মানুষের পাশে দাঁড়াবে। রাজ্য সরকার সকল দুর্গতদের কাছে পৌঁছচ্ছে। কয়েকটি ত্রাণ শিবির ঘুরে দেখলাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বললাম। ত্রাণের ব্যপারে দুর্গতেরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।”

(সহ-প্রতিবেদন: মহেন্দ্র জেনা)

theba village labhpur village firhad hakim arghya ghosh flood hit people labhpur flood hit people
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy