Advertisement
১৮ মে ২০২৪
বাঁধ কেটে নোনা জল সুন্দরবনে

ভেড়ির গ্রাসে বিপন্ন কৃষি, তদন্ত চায় কোর্ট

আয়লা ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তার ধাক্কা সুন্দরবন এখনও সামলে উঠতে পারেনি। এর মধ্যেই হাজির মুনাফালোভী কিছু মানুষের তৈরি বিপদ। তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই নদীবাঁধ কেটে ‘কুমির’ ডেকে আনায় ওই এলাকার অসংখ্য বাসিন্দার পেটে টান পড়ছে।

বাসন্তীর রামচন্দ্রখালিতে এ ভাবেই নদীর বাঁধ কেটে তৈরি হয়েছে মেছোভেড়ি। ছবি: সামসুল হুদা

বাসন্তীর রামচন্দ্রখালিতে এ ভাবেই নদীর বাঁধ কেটে তৈরি হয়েছে মেছোভেড়ি। ছবি: সামসুল হুদা

শমীক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৬ ০৪:২৬
Share: Save:

আয়লা ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তার ধাক্কা সুন্দরবন এখনও সামলে উঠতে পারেনি। এর মধ্যেই হাজির মুনাফালোভী কিছু মানুষের তৈরি বিপদ। তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই নদীবাঁধ কেটে ‘কুমির’ ডেকে আনায় ওই এলাকার অসংখ্য বাসিন্দার পেটে টান পড়ছে। এই কুমিরের নাম নোনা জল। আয়লায় নোনা জল কৃষির দফারফা করে ছেড়েছিল। এখন কিছু ভেড়ি ব্যবসায়ী নোনা জলকে চাষের জমিতে ঢোকার রাস্তা করে দিয়ে মহাবিপদ ডেকে আনছেন বলে অভিযোগ তুলে মামলা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে।

যত্রতত্র নদীবাঁধ কেটে মাছের ভেড়ি তৈরির জেরে কৃষিজমি বরবাদ হতে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। এই বিষয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের রিপোর্ট পেয়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, নিয়মবিধির তোয়াক্কা না-করে অবাধে নদীবাঁধ কাটার ফলে নোনা জল ঢুকে কৃষিজমি নষ্ট তো হচ্ছেই। সেই সঙ্গে বিঘ্নিত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। মাটির উপরকার এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তরেও এর প্রভাব পড়ছে বলে আশঙ্কা উচ্চ আদালতের।

হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী মঙ্গলবার ওই জেলার মৎস্য দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে নির্দেশ দিয়েছেন, অভিযুক্ত ভেড়ি-মালিকদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ভেড়ির লাইসেন্স নিয়েও যাঁরা আইন ভেঙে ভেড়ির আয়তন বাড়িয়ে চাষের সর্বনাশ করছেন, প্রয়োজনে বাতিল করতে হবে তাঁদের ব্যবসার লাইসেন্সও।

জলিল সর্দার নামে বাসন্তী থানা এলাকার ভরতগড় আনন্দআবাদ গ্রামের এক বাসিন্দা হাইকোর্টে মামলা ঠুকে অভিযোগ করেছেন, প্রভাবশালী ভেড়ি-মালিকদের একাংশ মাতলা নদীর বাঁধ অবাধে কেটে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমিকে নিজেদের ভেড়ির সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন। এর ফলে ওই সব জমিতে চাষ বন্ধ তো হচ্ছেই। সংলগ্ন জমিতেও নদীর নোনা জল ঢুকে বহু কৃষকের জমিতে অনাবাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। চাষের জমি থেকে নোনা জল বেরোতে না-পারায় চাষের কাজ বন্ধ। আর আবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর মতো হাজারো কৃষকের সংসার চলছে না। স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে সব জানিয়েও লাভ হয়নি বলে জলিলের অভিযোগ। সুরাহা পেতে মাসখানেক আগে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তিনি।

আবেদনকারীর আইনজীবী পরিমলকুমার দুয়ারি জানান, এর আগের শুনানিতে বিচারপতি বাগচী জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অবাধে বাঁধ কাটার যে-অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে একটি রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। এ দিন সরকারি কৌঁসুলি সুশোভন সেনগুপ্ত সেই রিপোর্ট আদালতে পেশ করেন। সেটি খুঁটিয়ে দেখে বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘‘জেলাশাসকের রিপোর্টে বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টি গুরুতর আকার নিয়েছে। পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন জেলাশাসক।’’ বিচারপতির নির্দেশ, যথাযথ অনুমতি না-নিয়ে যাঁরা মাছ চাষ করছেন, বেআইনি ভাবে ভেড়ির (স্থানীয় ভাবে যাকে ঘেরি-ও বলা হয়) এলাকা বাড়িয়ে নিয়ে বাসিন্দাদের দুর্দশার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, মৎস্য দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরকারি কৌঁসুলি আদালতে জানান, এটা শুধু বাসন্তী থানা এলাকার সমস্যা নয়। অবাধে নদীবাঁধ কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি করা হচ্ছে সুন্দরবনের প্রায় সব এলাকায়। এটা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। নইলে চাষ-আবাদ স্তব্ধ হয়ে যাবে। রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে বিস্তীর্ণ এলাকারা জমি-নির্ভর বাসিন্দাদের।

বিচারপতি বাগচী তার পরেই সরকারি কৌঁসুলির উদ্দেশে বলেন, ‘‘মৎস্য দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে পুরো বিষয়টিরই তদন্ত করতে হবে। যদি তিনি দেখেন, অভিযুক্তেরা আইনমাফিক অনুমতি না-নিয়ে ভেড়ি চালাচ্ছেন এবং ভেড়ির এলাকা অবৈধ ভাবে বাড়িয়ে চলেছেন, কালবিলম্ব না-করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাঁরা ব্যবসার ছাড়পত্র নিয়েও বেআইনি কাজ করে চলেছেন, বাতিল করতে হবে তাঁদের ভেড়ির লাইসেন্স।’’

দু’সপ্তাহ পরে ফের শুনানি হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

investigation Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE