Advertisement
E-Paper

জখমকে ফেরাল কলকাতার পাঁচ হাসপাতাল

রাজ্যের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত হয়েছে বলে বারবারই দাবি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজধানী কলকাতার সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী প্রত্যাখানের ‘রোগ’ সারছে না। এক মাস আগে কেশপুরে বাস দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কলকাতার তিন সরকারি হাসপাতাল।

প্রকাশ পাল

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৫৯
শ্রমজীবী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সঞ্জয় প্রামাণিক। নিজস্ব চিত্র।

শ্রমজীবী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সঞ্জয় প্রামাণিক। নিজস্ব চিত্র।

রাজ্যের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত হয়েছে বলে বারবারই দাবি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজধানী কলকাতার সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী প্রত্যাখানের ‘রোগ’ সারছে না।

এক মাস আগে কেশপুরে বাস দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কলকাতার তিন সরকারি হাসপাতাল। শনিবার তার চেয়েও বেশি ভুগতে হল শ্রীরামপুরের সঞ্জয় প্রামাণিককে। একটি আবাসনের তিন তলা থেকে পড়ে শিরদাঁড়া ও হাতে গুরুতর চোট পাওয়া সঞ্জয়কে রাতভর ঘুরতে হল কলকাতার পাঁচ হাসপাতালে। কোথাও জায়গা না পেয়ে প্রায় ভোররাতে তাঁর ঠাঁই হল বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে।

কেশপুরের ছেলেটিকে যে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি, এক মাস আগে তা মেনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘রোগীর অবস্থা খুব গুরুতর হলে কোনও ভাবেই ফিরিয়ে দেওয়ার কথা নয়। আগে তাকে স্থিতিশীল করা জরুরি ছিল।’’ কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তার ওই বার্তার পরেও কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলির কর্তৃপক্ষের হুঁশ কতটা ফিরেছে, সে প্রশ্ন তুলে দিল সঞ্জয়ের ফিরে আসা।

এসএসকেএম, এনআরএস এবং বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেশপুরের পরীক্ষার্থীকে। সর্বত্রই তাঁর পরিবারের লোককে শুনতে হয়েছে, ‘বেড নেই। ভর্তি নেওয়া যাবে না’। সঞ্জয়কে ফিরিয়ে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি, এসএসকেএম, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল এবং এনআরএস হাসপাতাল। পাঁচ জায়গাতেই তাঁর পরিবারকেও শুনতে হয়েছে একই কথা। সঞ্জয়ের জামাইবাবু তাপস সাহার ক্ষোভ, ‘‘সব জায়গাতেই প্রয়োজনে ট্রলি বা মেঝেতে রেখে চিকিৎসা করানোর অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ শোনেননি।’’

কেন বারবার একই ঘটনা?

স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, গোটা রাজ্যে এসএসকেএম ছাড়া আর কোথাও ইমার্জেন্সি নিউরো-সার্জারির পরিকাঠামো নেই। সেই কারণেই অন্য হাসপাতালে গেলে রোগীকে এসএসকেএমেই ‘রেফার’ করা হয়। আর গোটা রাজ্যের চাপ একা সামলাতে হয় বলে এসএসকেএমে শয্যার আকাল প্রায় সব সময়েই। সঞ্জয় প্রামাণিককে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখান করার মূল কারণ এটাই।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্তবাবু অবশ্য এ বারও বলেন, ‘‘যা-ই হোক না কেন, রোগীকে স্থিতিশীল না করে অন্য হাসপাতালে ঠেলে দেওয়াটা ঠিক নয়। বার বার বলা সত্ত্বেও কেন এমন হচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

শ্রীরামপুরের নওঁগা জেলেপাড়ার বাসিন্দা, বছর ত্রিশের সঞ্জয় পেশায় গেঞ্জি কারখানার শ্রমিক। শুক্রবার রাতে পাড়ার সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ তৈরির কাজ করছিলেন তিনি। একটি বাঁশের মাচা আনার জন্য তিনি পাশের নির্মীয়মাণ আবাসনে যান। সেখানেই তিন তলা থেকে লিফটের জায়গা (এখনও লিফট বসানো হয়নি) দিয়ে নীচে পড়ে যান। রাতেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে। বাড়ির লোকজন জানান, সেখানে ব্যথা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। শনিবার এক্স-রে করা হয়। তাতে কোমরের উপরে শিরদাঁড়ায় চোট ধরা পড়ে। দেখা যায়, বাঁ হাতটিও ভেঙে গিয়েছে। চিকিৎসকেরা জানান, দু’জায়গাতেই অস্ত্রোপচার করাতে হবে। কিন্তু পরিকাঠামো না থাকায় তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল‌ কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হয়। এর পরেই শুরু ভোগান্তি।

জেলায় বসেই যাতে আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ মেলে, সেই লক্ষ্যে রাজ্যের নানা প্রান্তে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল গড়ে তুলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। হুগলিতে অবশ্য এখনও তেমন কোনও হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালকেই ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ সবে শুরু হয়েছে। ফলে, ওই হাসপাতালের পরামর্শমতো শনিবার বিকেলে সঞ্জয়কে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে পরিবারের লোকেরা প্রথমে হাজির হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁদের দাবি, সেখানে এক্স-রে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকেরা তাঁদের বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে সঞ্জয়কে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ তাঁরা সেখানে পৌঁছন। কিন্তু সঞ্জয়কে ভর্তি করা হয়নি। সেখানেও শোনানো হয়, ‘বেড নেই’। এর পরে তাঁরা এসএসকেএম এবং শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে যান। একই অভিজ্ঞতা হয় সেখানেও।

এর পরে সঞ্জয়কে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ছোটে নীলরতন সরকার হাসপাতালের দিকে। রাত সওয়া ১০টা নাগাদ সেখানে গিয়েও লাভ হয়নি। উপায়ান্তর না দেখে এনআরএস থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। রাত পৌনে ৩টে নাগাদ সঞ্জয়কে ভর্তি করানো হয় বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে। রবিবার সকালে সেখানকার অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয়কে দেখেন। ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, শিরদাঁড়া এবং হাত দু’জায়গাতেই অস্ত্রোপচার করতে হবে।

ওই হাসপাতালের তরফে গৌতম সরকার বলেন, ‘‘২৪ ঘণ্টা সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় আমরা জরুরি অস্ত্রোপচারের রোগী ভর্তি নিতে পারি না। কিন্তু যন্ত্রণার উপশম করার জন্য ওই রোগীকে শনিবার গোটা দিন কার্যত বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। সে জন্য ওঁকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে। ওঁকে পুরোপুরি সারিয়ে তোলাটাই আমাদের লক্ষ্য।’’

সঞ্জয়ের পরিবারের ক্ষোভ, কলকাতার হাসপাতালগুলি অন্তত যন্ত্রণা কমানোর ব্যবস্থাটুকুও করার সদিচ্ছা দেখাল না।

kolkata injured hospital city
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy