মিরিকে ধসে মাটিতে মিশে গিয়েছে বাড়ি। ছবি: রবিন রাই।
সিকিম পাহাড়ে একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে বুধবার ডুবে গেল তিস্তা নদীর অসংরক্ষিত এলাকা। জলের তলায় চলে গিয়েছে চর দখল করে গজিয়ে ওঠা বসতি-সহ চাষের মাঠও। দিনভর বিপদসীমার উপরে ছিল নদীর জলস্তর। সকালে তিস্তায় লাল সঙ্কেত দেওয়া হয়। বেলা যত বেড়েছে জলস্তর বেড়েছে। জেলা পরিষদের তৈরি পাকা রাস্তা জলে তলিয়ে গিয়েছে। উড়ে গিয়েছে নদীর চরে তৈরি কৃষি দফতরের মৃত্তিকা সংরক্ষণ বিভাগের তৈরি মাটির বাঁধ। উদ্ধার কাজে নেমেছেন সেনা জওয়ান ও বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীরা। সরকারি হিসেবে ময়নাগুড়ি ও রাজগঞ্জ ব্লক এবং মালবাজার মহকুমায় অন্তত ২০ হাজার মানুষ জলবন্দি। তাঁদের উদ্ধার করে বিভিন্ন স্কুলে রেখে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসেবে বিপন্ন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।
উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান গৌতম দত্ত বলেন, “মঙ্গলবার রাতে সিকিমে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ওই জল নামতে তিস্তা নদীর অসংরক্ষিত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদী বাঁধের কোনও ক্ষতি হয়নি। দিনভর পাহাড়ে বৃষ্টি ছিল না। আশা করছি বিকেলের পরে জলস্তর নামবে।” তিস্তায় জলস্ফীতির খবর পেয়ে এ দিন সকাল থেকে উদ্ধার কাজ তদারকিতে নেমেন প্রশাসনের কর্তারা। জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক সীমা হালদার বলেন, “প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে ময়নাগুড়ি এবং রাজগঞ্জ ব্লকে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়েছে। ময়নাগুড়ির ধর্মপুর এবং পদমতি এলাকায় উদ্ধার কাজে সেনা বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। জলবন্দিদের উদ্ধার করে বিভিন্ন স্কুল বাড়িতে রাখা হচ্ছে।” মালবাজারের মহকুমাশাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি বলেন, “মহকুমায় আট হাজার মানুষ জলবন্দি হয়েছেন। বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীরা উদ্ধার কাজ করছে। সেনার সাহায্য চাওয়া হয়েছে।”
বিপন্ন বাসিন্দারা জানান, বুধবার ভোর থেকে নদী ফুঁসে উঠতে শুরু করে। বেলা বাড়তে প্লাবিত হয় ময়নাগুড়ি ব্লকের বর্মনপাড়া, চাতরার পাড়, মতিয়ার চর এবং উত্তর পদমতি, ধর্মপুর ও বার্নিশ গ্রামের নদীর চরের বসতি এলাকা। জল ঢুকে পড়ে রাজগঞ্জ ব্লকের বিরেন বস্তি, ধূপগুড়ি বস্তি, তুলসীর ঘাট, টাকিমারি চর, নাথুয়া চর এলাকায়। স্থানীয় বিধায়ক খগেশ্বর রায় জানান, সেখানে উদ্ধার কাজে পাঁচটি দেশি নৌকা নামান হয়েছে। দুপুর নাগাদ বিন্নাগুড়ি থেকে ৩৫ জন সেনা জওয়ানের একটি দল মতিয়ার চর, উত্তর পদমতি ও ধর্মপুর এলাকায় পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ দিন পাকা রাস্তার সেতু তলা দিয়ে জল ঢুকে ভেসে যায় মালবাজার মহকুমার মাস্টার পাড়া, কেরানি পাড়া, ঠাকুরদাস পাড়া। নদীর জলস্তর বাড়তে দেখে আতঙ্কিত বাসিন্দাদের অনেকে ভোর থেকে নিজেরাই থার্মোকলের তৈরি ভেলায় আসবাবপত্র, ধান, গবাদি পশু উদ্ধার করে সেচ দফতরের বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। পরে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কাজে নামেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষে দেশি নৌকা নামান হয়। এ দিন সকাল থেকে প্রশাসনের তরফে চর এলাকা ছেড়ে উঁচু নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য মাইকে প্রচার শুরু হলেও প্রথমে অনেকে গুরুত্ব না দিয়ে জল কতটা বাড়ছে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু বেলা দশটার পরে কেউ আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। শুরু হয় বুক সমান জল ভেঙে বাঁধের দিকে পালানো।
দুপুর নাগাদ নদী চর ছাপিয়ে সেচ দফতরের বাঁধের গোড়ায় চলে আসে। জলে তলিয়ে যায় জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের তৈরি ময়নাগুড়ি-ক্রান্তি পাকা সড়কের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিচ্ছিন্ন হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ময়নাগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুভাষ বসু এলাকা ঘুরে জানান, দুপুরে বর্মনপাড়ার কাছে কৃষি দফতরের মৃত্তিকা সংরক্ষণ বিভাগের তৈরি মাটির বাঁধ উড়ে যায়। উত্তাল ঢেউ আছড়ে পরে চরের বসতি এলাকায়। ভেসে যায় বাঁশ বাগান, পচাতে দেওয়া পাট, ধান খেত। আধঘণ্টার মধ্যে তিস্তার ঘোলা জল বসতি এলাকার ঘরের প্রায় টিনের চাল ছুঁয়ে যায়। বাসুসুবা গ্রামের বাসিন্দা ক্ষীরচরণ রায়, সুশীলা রায়দের কথায়, ‘‘গত দু’দশকে তিস্তার জলস্তর এ ভাবে বাড়তে দেখিনি। বাসুসুবা সেনপাড়া এলাকায় গলা পর্যন্ত জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে।’’ মালবাজার মহকুমার চাঁপাডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান রমণীকান্ত রায় জানান, মাস্টারপাড়া, কেরানিপাড়া, ঠাকুরদাসপাড়ায় অন্তত পাঁচশো পরিবার জলবন্দি হয়েছে। তাঁদের উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে রাখা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy