Advertisement
E-Paper

প্রতারণার অভিযোগে ধৃত বিদ্রোহী আসিফ

সারদা কাণ্ডে তিনি এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে সিবিআই এই কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত বহু তথ্য হাতে পেয়েছে বলে মনে করে তৃণমূলেরই একাংশ। সেই আসিফ খানকে একটি জমি সংক্রান্ত প্রতারণার মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করল বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ। এর আগে একাধিক বার আসিফ অভিযোগ করেছিলেন, শাসক দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় পুলিশ তাঁকে হেনস্থা করছে। তাঁর দাবি ছিল, তাঁকে ভুয়ো প্রতারণা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪২
গ্রেফতার হওয়ার পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার রাতে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে আসিফ খান। ছবি: সুমন বল্লভ।

গ্রেফতার হওয়ার পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার রাতে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে আসিফ খান। ছবি: সুমন বল্লভ।

সারদা কাণ্ডে তিনি এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে সিবিআই এই কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত বহু তথ্য হাতে পেয়েছে বলে মনে করে তৃণমূলেরই একাংশ। সেই আসিফ খানকে একটি জমি সংক্রান্ত প্রতারণার মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করল বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ।

এর আগে একাধিক বার আসিফ অভিযোগ করেছিলেন, শাসক দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় পুলিশ তাঁকে হেনস্থা করছে। তাঁর দাবি ছিল, তাঁকে ভুয়ো প্রতারণা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এমনকী, বিধাননগর কমিশনারেটে ডেকে পাঠিয়ে ‘সিবিআইকে কী বলেছেন, না বললে ৩০০ মামলায় ফাঁসিয়ে দেব’ বলে পুলিশ তাঁকে হুমকি দিচ্ছে, এমনও বক্তব্য ছিল তাঁর।

শেষ পর্যন্ত সেই বিধাননগর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না তৃণমূলে একদা মুকুল রায়ের ছায়াসঙ্গী হিসেবে পরিচিত আসিফ খান। গত মাস দেড়েক ধরে লাগাতার সারদায় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের যোগ নিয়ে বোমা ফাটিয়ে আসছিলেন তিনি। খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং মুকুলের নামে বিস্ফোরক সব অভিযোগ আনছিলেন। সে সময়টায় তৃণমূলের অন্দরে মমতার সঙ্গে মুকুলেরও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, এখন গত তিন দিন ধরে সেই সমীকরণ বদলাতে শুরু করেছে। সামনে পুরভোট। ফের গাড়িতে মমতার সঙ্গী হয়েছেন মুকুল রায়। এবং এই সময়েই দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরেছিলেন আসিফ। বুধবার রাত থেকেই তাঁকে পাকড়াও করার ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করে পুলিশ। বৃহস্পতিবারই সাফল্য পেল তারা।

এই মুহূর্তে সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই অবশ্য রাঘববোয়ালদের ঘিরে জাল গুটিয়ে আনছে। এর মধ্যে তারা প্রথম চার্জশিটটি পেশ করেছে। সম্ভবত কিছু দিনের মধ্যে দ্বিতীয় চার্জশিটও এসে পড়বে। এই পুরো তদন্তে যে সব ব্যক্তি বা মহল থেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা সাহায্য পাচ্ছিলেন, আসিফ তার অন্যতম।

আসিফ সারদা মামলার এত কথা জানলেন কী ভাবে? সারদা বন্ধ হওয়ার পরে সারদার ‘কলম’ পত্রিকার ভার আসিফের উপরেই পড়েছিল। ২০০৮ সাল থেকে আসিফ ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের ছায়াসঙ্গী। এই একই সময়ে সারদা-র ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে ওঠে। বিশেষ করে ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিলে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা পর্যন্ত এই সংস্থার রমরমা ছিল। সিবিআই সূত্রের খবর, দলে এই সময়কার যাবতীয় আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে বহু তথ্য দিয়েছেন আসিফ। এই প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলেও তা স্বীকার করেছেন।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে এই সব তথ্য দেওয়ার সময়েই তিনি বারবার প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। পরে সংবাদমাধ্যমেও সরাসরি মমতার দিকে আঙুল তোলেন তিনি। মমতাকে মিথ্যেবাদী বলেন। অভিযোগ করেন, সারদা কাণ্ডে দল যে এ ভাবে ডুবে গিয়েছে, তা মমতা জানতেন না এটা হতে পারে না। আসিফ দাবি করেন, সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার আগে থেকেই সারদার সংবাদমাধ্যম দখল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাতে মুকুল এবং তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু রায়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল বলেও তাঁর অভিযোগ। কলকাতা ছাড়ার আগে সুদীপ্ত সেন যে নিজাম প্যালেসে মুকুলের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, সেটাও আসিফ খোলাখুলি দাবি করেছিলেন।

ঘটনাচক্রে, এই সময়েই আসিফের বিরুদ্ধে একটি প্রতারণা মামলা রুজু হয়। কুড়ি কোটি টাকার সেই মামলায় আসিফ আগাম জামিনও নেন। এর পর আট কোটি টাকার দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করা হয় গত ৪ সেপ্টেম্বর। আসিফের অভিযোগ, পুজোর মুখে তাঁকে একাধিক বার তলব করে বিধাননগর কমিশনারেট। কিন্তু তখন তাঁকে এই মামলা নিয়ে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানানো হয়নি।

এর পরে আসিফ চলে যান দিল্লিতে। সেই সময় তাঁর নামে কমিশনারেট থেকে দু’টি নোটিস আসে। কিন্তু দিল্লিতে থাকায় আসিফের পক্ষে হাজিরা দেওয়া সম্ভব হয়নি। আসিফের বক্তব্য, তিনি চিঠি দিয়ে সে কথা জানিয়েওছিলেন।

আসিফের ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, মেয়ের চিকিৎসার জন্য সবেমাত্র দিন দুয়েক হল কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। আর বুধবার রাত থেকেই তাঁকে ধরার জন্য পুলিশের উপর মহল থেকে চাপ আসতে শুরু করে বিধাননগর কমিশনারেটের উপরে। পুলিশের একাংশ এ কথা প্রকারান্তরে মেনেও নিয়েছেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টা খোঁজ চালানোর পরে বৃহস্পতিবার রাতে আসিফকে তিলজলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নিউটাউন থানায়।

কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই জানান, আসিফের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি, ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি শর্তসাপেক্ষে এবং শেষের দু’টি পুরোপুরি জামিন অযোগ্য ধারা। ফলে শুক্রবার আসিফকে হেফাজতে চেয়ে (পুলিশ সূত্রে খবর, নিজেদের হেফাজতেই চাইবে তারা) আদালতে আবেদন করতে কোনও সমস্যা নেই পুলিশের। যদিও শারীরিক পরীক্ষার সময় আসিফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে রাতেই নীলরতন সরকার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

প্রশ্ন উঠেছে আসিফ বহু দিন ধরেই প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন! এত দিন পরে তাঁকে গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশ তৎপর হল কেন? বিরোধীদের অনেকেই বলছেন, তৃণমূলের অন্দরের রাজনৈতিক বিন্যাস বদলের সঙ্গে সঙ্গেই আসিফকে গ্রেফতারের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, “মুকুল নেত্রীর গাড়িতে উঠলেন আর আসিফ গ্রেফতার হলেন এই দুই ঘটনা কি কাকতালীয়?” যদিও মুকুলবাবু বলেন, “আমি এই গ্রেফতারের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আর আসিফ তো এখন আমাদের দলের কেউ নয়।”

বিরোধীরা বলছেন, এত দিন ধরে প্রভাবশালী কারও ছত্রচ্ছায়ায় থাকার ফলেই আসিফকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। সম্প্রতি রাজনৈতিক সমীকরণে বদলের পরে সেই ছায়া সরে যায় আসিফের মাথা থেকে। এই সময়ে তাঁর কলকাতায় ফিরে আসা নিয়েও তাই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পুলিশ যে গত ২৪ ঘণ্টা ধরে আসিফকে ধরতে তৎপর, সেটাকেও কি কাকতালীয় বলা সম্ভব?

এর আগে বহু বার আসিফ অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলে প্রতিবাদের কোনও জায়গা নেই। প্রতিবাদ করলেই জেল। তিনি এ ব্যাপারে কুণাল ঘোষের উদাহরণও দিয়েছেন। বলেছেন, তাঁর আশঙ্কা, তাঁকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে পাকড়াও করতে পারে পুলিশ। আর এক বার ধরতে পারলে কুণালের মতোই নানা মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হবে। তাঁর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রের বক্তব্য, এ বারে হয়তো সেই আশঙ্কাই সত্যি হতে চলেছে।

saradha scam Asif Khan tmc bidhannagar police commissionerate state news online state news former TMC leader arrest police arrest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy