Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তিন যদির উপর দাঁড়িয়ে ইস্কোর ভবিষ্যৎ

‘যদি’র তেপায়ার উপর দাঁড়িয়ে নতুন ইস্কোর ভবিষ্যৎ। আজ, রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে উদ্বোধনের পরে নতুন উদ্যমে পথ চলা শুরু করবে নবকলেবরের ইস্কো। সেই উপলক্ষে বার্নপুর-আসানসোলে উৎসবের মেজাজ রয়েছে। আছে এক মঞ্চে মোদী-মমতাকে দেখার ঔৎসুক্য। কিন্তু ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাস ঝেড়ে ফেলে লাভজনক হয়ে ওঠার নতুন রাস্তার সন্ধান এই নতুন ইস্কো পাবে কি? প্রধানমন্ত্রীর পা পড়ার আগের দিন বার্নপুর-আসানসোল-কুলটিতে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্ন।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
বার্নপুর শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

‘যদি’র তেপায়ার উপর দাঁড়িয়ে নতুন ইস্কোর ভবিষ্যৎ।

আজ, রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে উদ্বোধনের পরে নতুন উদ্যমে পথ চলা শুরু করবে নবকলেবরের ইস্কো। সেই উপলক্ষে বার্নপুর-আসানসোলে উৎসবের মেজাজ রয়েছে। আছে এক মঞ্চে মোদী-মমতাকে দেখার ঔৎসুক্য। কিন্তু ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাস ঝেড়ে ফেলে লাভজনক হয়ে ওঠার নতুন রাস্তার সন্ধান এই নতুন ইস্কো পাবে কি? প্রধানমন্ত্রীর পা পড়ার আগের দিন বার্নপুর-আসানসোল-কুলটিতে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্ন।

সংস্থা কর্তাদের গলায় আশার উজান। কিন্তু অনেকেরই বিশ্লেষণে আবার আশঙ্কার চোরাবালি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উঠে আসছে একটিই প্রশ্ন। তা হল, বিপুল টাকা বিনিয়োগে ইস্পাতের যে সব পণ্য উৎপাদনের বন্দোবস্ত হল, তা বিক্রির জন্য বাজার আদৌ পাওয়া যাবে তো? কারণ, তবেই না সেই মারকাটারি চাহিদার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে নতুন চেহারার ইস্কো। আর এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই মালুম হচ্ছে যে, ইস্কোর ভবিষ্যৎ কার্যত দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন ‘যদি’র উপর ভর করে।

এক, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র সাফল্য। শিল্প হলে চাহিদা বাড়বে ইস্পাতের। দুই, পরিকাঠামোয় কেন্দ্রের বিপুল বিনিয়োগ এবং সেখানে বেসরকারি লগ্নি টেনে আনা। কারণ, পরিকাঠামো নির্মাণে ইস্পাতের চাহিদা চোখে পড়ার মতো। আর তিন, দেশের বৃদ্ধির হার দীর্ঘ মেয়াদে অন্তত ৮-৯ শতাংশে থিতু হওয়া। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, এই সমস্ত শর্ত পূরণ হলে, একমাত্র তবেই সাফল্যের মুখ দেখবে ইস্কোর আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ প্রকল্প। নয়তো পণ্য তৈরি করেও হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে বাজারের অপেক্ষায়। ফিরে আসবে ইতিহাসের ব্যর্থতা। মুনাফার মুখ না-দেখার যন্ত্রণা ফের তাড়া করবে তাকে।

সংস্থাটির কর্তাদের অবশ্য দাবি, ইস্কোর ‘অচ্ছে দিন’ আসছে। এর পক্ষে মূলত দু’টি যুক্তি তুলে ধরছেন তাঁরা— এক, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেল-এর সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে ১৬ হাজার কর্মী নিয়ে ৩৫ হাজার টন ইস্পাত তৈরি হত এখানে। সেখানে এখন ন’হাজার কর্মী নিয়ে বছরে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ লক্ষ টন। অর্থাৎ, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে অনেকখানি। ফলে কমেছে খরচ। পাঁচ দেশের সাত সংস্থার প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছে আধুনিক কারখানা।

দুই, আগামী দু’তিন বছরে দেশে ইস্পাতের চাহিদা বিপুল পরিমাণে বাড়বে বলে আশা করছেন সংস্থার কর্তারা। কারণ তাঁদের মতে, পরিকাঠামো, আবাসন, গাড়ি— চাহিদা বাড়বে সমস্ত শিল্পেই।

কিন্তু ঠিক এখানেই আবার আশঙ্কার চোরাবালি দেখছেন অনেকে। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, ইস্পাত তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় কোকিং কোল আর লাইম স্টোন। গত পাঁচ বছরে ইস্কোয় সে ভাবে তার ব্যবহার বেড়েছে কোথায়? গত তিন বছরে কেন প্রায় একই থেকে গিয়েছে সংস্থার দেওয়া বিক্রয় করের অঙ্ক? বিক্রি বাড়লে তো এই দু’টিই বাড়ার কথা। সেই কারণেই ইস্কোর ভবিষ্যৎ আসলে তিন ‘যদি’র সুতোয় ঝুলে রইল বলে মনে করছেন তাঁরা।

বেজিং অলিম্পিকের আগে সারা দেশের পরিকাঠামো ঢেলে সেজেছিল চিন। ইস্পাতের রমরমা বাজার তৈরি হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তা মেটার পর থেকে বিশ্ব বাজারে ইস্পাতের চাহিদা এখনও তলানিতে। তাতে আবার ইন্ধন জুগিয়েছে বিশ্বজোড়া মন্দার প্রভাব। অবস্থা এমনই যে, ফল ভাল করতে খাবি খাচ্ছে আর্সেলর-মিত্তলের মতো সংস্থাও। ফলে এই পরিস্থিতিতে নতুন করে দৌড় শুরু করতে দেশের বাজারকেই পাখির চোখ করতে হবে ইস্কোকে।

আর সেই কারণেই ইস্কোর সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝে এত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে তিনটি ‘যদি’। কারণ, দেশে বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু শিল্প বৃদ্ধি এখনও নড়বড়ে। সে ভাবে সাড়া দেয়নি পরিকাঠামো ক্ষেত্রও। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন, ইস্পাতের পণ্যের বাজার এখনও সে ভাবে কোথায়? বিশেষত যেখানে দেশে বরং কমেছে মাথাপিছু ইস্পাতের চাহিদা। এমনিতে আগে কোনও দিনই লাভের মুখ দেখেনি দেশের অন্যতম পুরনো ইস্পাত কারখানা ইস্কো। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ। এক সময় ধুঁকতে থেকে বিআইএফআরে চলে যাওয়া। শেষমেশ ২০০৬ সালে তা মিশে যায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেল-এর সঙ্গে। কয়েক হাজার কোটি টাকা ঢেলে ইস্কো সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও ওই সময়ই। বহু বার ইস্কো কারখানা বিক্রির চেষ্টা হয়েছে। খবরে উঠে এসেছে দেশি-বিদেশি সংস্থার নাম। কিন্তু বিপুল সংখ্যক কর্মী ও লোকসানের বোঝা নিয়ে চলা সংস্থাটিকে নিতে এগিয়ে আসেনি কোনও বেসরকারি সংস্থাই।

তবে লাভের মুখ না-দেখলেও, হাতে খনিজ সম্পদের অভাব কোনও দিনই ছিল না ইস্কোর। চিরিয়া ও দুয়া আকরিক লোহার খনি। সঙ্গে চাষনালা, রামনগর ও জিকপুর কয়লা খনি। বলা চলে, এই খনিজের জোরেই ২০০৪ সালে ভেসে থাকতে পেরেছিল ইস্কো। তৎপালীন ইস্পাতমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান ঘোষণা করেন, সেল ও ইস্কো মিশিয়ে দেওয়ার কথা। যাতে ইস্কোর খনিজ সম্পদ নিজেদের উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারে সেল।

এই সব কিছুর মাঝে আবার জমি আন্দোলনের জেরে থমকে গিয়েছিল সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ। ফের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু পরে গ্রামবাসীরা দাবিমতো ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে জমি দেওয়ায় শেষ হয়েছে প্রকল্পের কাজ।

আশা-আশঙ্কার এই দোলাচলে নতুন ভবিষ্যতের খোঁজে আজ দৌড় শুরু করছে ইস্কো। সেখানে তৈরি হবে টিএমটি বার, বিম ইত্যাদি। প্রশ্ন থাকছে, তার উপযুক্ত বিপণন কৌশল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঝুলিতে আছে তো?

এর উত্তর ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু আজ অন্তত আসানসোল উপনগরী জুড়ে কিছুটা উৎসবের মেজাজ। একই মঞ্চে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য এক টাকায় জমি দিয়েছে। আর কেন্দ্র ঢেলেছে অর্থ। দুইয়ে ভর করে যেন ইস্কোর মরা গাঙে বান আনার স্বপ্ন। আসানসোল উপনগরীর রাস্তার দু’পাশে পাশাপাশি রাখা বিজেপি আর তৃণমূলের পতাকা। কোথাও মমতা এবং মোদীর ছবিও। অনেক জায়গায় আবার প্রধানমন্ত্রীর ইয়া বড় ছবি। স্থানীয় বিধায়ক মলয় ঘটক বলেন, ‘‘আমরা খুশি। ইস্কো খুলছে। কারখানার কাজ যাতে একদিনও বন্ধ না হয়, সে দিকে নজর থাকবে।’’ আর আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, ‘‘কেন্দ্র সারা দেশে ১০০টি স্মার্ট সিটি গড়বে। বিপুল লগ্নি হবে পরিকাঠামোয়। ফলে ইস্পাতের চাহিদা বাড়তে বাধ্য।’’

আশার এই হাওয়াতেই আজ পাল টাঙাচ্ছে ইস্কো। আশঙ্কার ঘূর্ণি যদিও তার পিছু ছাড়েনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE