Advertisement
E-Paper

শিলিগুড়ির দ্বিতীয় ডার্বি চাই, তাল ঠুকছেন মেয়র-মন্ত্রী

রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও ভোট-ময়দানের প্রথম ‘ডার্বি’তে হেরেছেন এক জন। অন্য জন নানা শিবিরের খেলোয়াড়দের সামিল করে গোল করেছেন পুরভোটে। টগবগে করে দিয়েছেন বিরোধী শিবিরকে। পুজোর মরসুমে এ বার দ্বিতীয় ‘ডার্বি’ ঘিরে তাতছে শিলিগুড়ি। মহকুমা পরিষদের ভোটে দুই ‘ক্যাপ্টেন’ কে, কী কৌশল নিচ্ছেন তা নিয়ে চলছে জল্পনা।

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:০২
অশোক ভট্টাচার্য ও গৌতম দেব

অশোক ভট্টাচার্য ও গৌতম দেব

রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও ভোট-ময়দানের প্রথম ‘ডার্বি’তে হেরেছেন এক জন। অন্য জন নানা শিবিরের খেলোয়াড়দের সামিল করে গোল করেছেন পুরভোটে। টগবগে করে দিয়েছেন বিরোধী শিবিরকে। পুজোর মরসুমে এ বার দ্বিতীয় ‘ডার্বি’ ঘিরে তাতছে শিলিগুড়ি। মহকুমা পরিষদের ভোটে দুই ‘ক্যাপ্টেন’ কে, কী কৌশল নিচ্ছেন তা নিয়ে চলছে জল্পনা।

উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবকে পুরভোটে টেক্কা দেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। দল সূত্রের দাবি, সেই হারের জেরেই গৌতমবাবুকে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের চেয়ারম্যান, জলপাইগুড়ির রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদ খোয়াতে হয়েছে। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচনের (৩ অক্টোবর) ম্যাচ জিততে না পারলে ‘ক্যাপটেন্সি’ই না চলে যায়, আশঙ্কা তৃণমূলে গৌতম-ঘনিষ্ঠ অনেকের।

দলের অন্দরের খবর, পুরভোটের হার থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে গৌতমবাবু আগের চেয়ে বেশি মন দিয়েছেন ‘ডিফেন্স’-এ। কারণ, পুরভোটে ৪৭ আসনের মধ্যে ‘৩০-৩৫টা পাব’ গোছের আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে লাভ হয়নি তাঁর। সে যাত্রায় ভোটের দিন কংগ্রেস, বিজেপি, নির্দল-সহ তৃণমূল-বিরোধীদের একজোট করে শাসক দলকে বুথের আশেপাশে দাঁত ফোটাতে দেননি অশোকবাবু।

শুধু তা-ই নয়, যে সব জায়গায় সুযোগ পেয়েছেন, বিরোধী জোট গড়ে ‘বাপি বাড়ি যা’ কায়দায় চালিয়ে খেলে নিজের প্রার্থীকে জিতিয়েছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। এমনকী, সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে একটি আসন কম থাকলেও একদা গৌতমবাবুর ছায়াসঙ্গী অরবিন্দ ঘোষকে কাছে টেনে বোর্ডই গড়ে ফেলেছেন। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের আরও ভাবাচ্ছে, প্রায় আড়াই দশক মন্ত্রী থাকার সময়ে অশোকবাবুদের দখলেই ছিল মহকুমা পরিষদ। তখন থেকেই পরিষদের চারটি পঞ্চায়েত সমিতি, শতাধিক পঞ্চায়েতের অলিগলি অশোকবাবুর প্রায় হাতের তেলোর মতো চেনা।

এই তথ্য-পরিসংখ্যান কিছু অজানা নয় গৌতমবাবুর। তাই ন’টি আসনের মহকুমা পরিষদের দখল নিতে ‘মানুষের কাছে চলো’ কর্মসূচি নিয়েছেন তিনি। নকশালবাড়ির গ্রামে-গঞ্জে পড়ে থেকেছেন। নেপাল সীমান্তের খড়িবাড়িতে গিয়ে নেপালি ভাষীদের ঘরে ‘মোমো’ খেয়েছেন। ফাঁসিদেওয়ায় গিয়ে সংখ্যালঘুদের ঘরে সিমাইয়ের পায়েস চেখেছেন। এতে সভা-মিছিলে ভিড় বেড়েছে। কিন্তু সে ভিড় ভোটে বদলাবে কি না, সংশয় কাটেনি মন্ত্রীর।

তাই আদিবাসী বিকাশ পরিষদের যুযুধান দুই গোষ্ঠী—নিকোটিন মিনজ এবং জন বার্লার মত নিয়ে আদিবাসীদের পছন্দসই এক প্রার্থীকে মহকুমা পরিষদে দলের টিকিট দিয়েছেন গৌতমবাবু। কোথাও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, আবার কোথাও কংগ্রেস থেকে আসা দাপুটে নেতাকে দাঁড় করিয়েছেন। ‘ডিফেন্স’ মোটামুটি শক্তপোক্ত ধরে নিয়ে ‘কন্যাশ্রী, ‘স্বাস্থ্য বিমা’, ‘মুখ্যমন্ত্রীর বারবার উত্তরবঙ্গ সফর’, ‘সব্জি মান্ডি’, ‘আবাস যোজনা’, ‘সাইকেল এবং পাট্টা বিলি’র মতো প্রকল্পের খতিয়ান সামনে রেখে সকাল থেকে মাঝরাত অবধি মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছেন মন্ত্রী নিজেই।

এত সবের পরেও তৃণমূলের ‘ড্রেসিংরুম’-এ কান পাতলে খুব একটা আশার সুর শোনা যাচ্ছে না। বরং মন্ত্রী ব্লকভিত্তিক কয়েকজনকে দায়িত্ব দিলেও একাই প্রার্থী ঠিক করেছেন কেন, তা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভের কথা জানা গিয়েছে। কেন পেট্রোল পাম্পের মালিকের পরিবারের লোক বা জমির কারবারিকে টিকিট দেওয়া হল, কেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বাম-ঘনিষ্ঠ রেশন ডিলারকে পাশে বসিয়ে বৈঠক করা হয়েছে—তা নিয়ে প্রশ্ন কম নেই। এমনকী, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে দলের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশকে প্রায়ই আক্ষেপ করতে শোনা যায়। মন্ত্রী অবশ্য সব অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আর তৃণমূলের মনোবল ভাঙতে তাদের নেতা-কর্মীদের এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে চাইছেন অশোকবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘অনেকে আমাদের কাছে তাঁদের কয়েকজন নেতার উদ্ধত আচরণ নিয়ে দুঃখ করছেন। সবাইকে জবাব দিতে বলেছি ভোটের দিন।’’

বিরোধীদের আশা, তৃণমূলের ‘ডিফেন্স’ চিরে দিতে পারে গ্রামের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগও। গত পুরভোটের আগে শিলিগুড়ি শহরের প্রায় সব রাস্তা ঝাঁ চকচকে করে দেয় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর। বহু কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ গ্রামের অনেক রাস্তা আজও বেহাল কেন, সে প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ফাঁসিদেওয়া, নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, মাটিগাড়ার বহু রাস্তায় চলাই যায় না।’’

পুরভোটে অশোকবাবু ছিলেন ‘প্লেয়িং ক্যাপ্টেন’ — অনেকটা সময় নিজের ওয়ার্ডে দিতে হয়েছিল তাঁকে। এ বার সে ঝামেলা নেই। সাতসকালে পুরসভায় গিয়ে খানিকটা তদারকির পরেই ভোটের ময়দানে যাচ্ছেন রোজ। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। তৃণমূল-বিরোধীদের মধ্যে যাঁরা, যেখানে শক্তিশালী, তাঁদের কাছে ডেকে কোচ-সুলভ পরামর্শ দিয়ে উদ্দীপ্ত করছেন। আদিবাসী, নেপালিভাষী, রাজবংশী সম্প্রদায়ের ঘরে-ঘরে গিয়ে বৈঠক করে বলছেন, ‘‘শিলিগুড়ি শহর যা পেরেছে, তা আপনারাও করে দেখাতে পারবেন।’’

শিলিগুড়িতে অলিখিত সমঝোতার দৌলতে অশোকবাবুরা যেটা করেছিলেন, তা হল ভোটের দিন ভোটারদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করা। এ বার প্রচারের পর্ব থেকেই ময়দানে তৃণমূল-বিরোধীরা যাতে একজোট থাকেন, তাই পারস্পরিক নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার ‘টোটকা’ বাতলে দিয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। বিরোধীদের উপরে হামলার অভিযোগ, ‘স্মার্ট সিটি’র তালিকায় শিলিগুড়ির নাম না ওঠা, সামগ্রিক উন্নয়নের বদলে বছরভর উৎসবের সমালোচনা—নানা প্রশ্নের মুখে ফেলতে হবে শাসক দলকে। এমন মন্ত্রে ‘উদ্বুদ্ধ’ এক ঝাঁক ‘ফরোয়ার্ড’কে মাঠে নামাতেও পেরেছেন শিলিগুড়ির মেয়র। এলাকা ঘুরলেই শোনা যাচ্ছে, বামেরা তো বটেই, আড়ালে- প্রকাশ্যে তৃণমূলের ‘গোল’ লক্ষ করে প্রায় একগোত্রের ‘শট’ নিচ্ছেন কংগ্রেস, বিজেপি-র নেতারাও।

আবার সেই ‘টোটকা’র দৌলতেই প্রকাশ্যে না হলেও, আড়ালে বিরোধীদের মধ্যে নিচুতলায় অনেক আসনেই সমঝোতা হয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলছে। যেমন, সিপিএমেরই একাংশ মনে করে, ফাঁসিদেওয়াতে কংগ্রেসের মহকুমা পরিষদ প্রার্থীর চাইতে ওজনে তাদের প্রার্থী অনেকটাই কম। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি খড়িবাড়িতে বামেদের প্রার্থী না কি দুর্বল! গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে যে কত আসনে সমঝোতা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তৃণমূলের অনেকের আশঙ্কা, শতাধিক আসনে বিরোধীদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে। ফলে, মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের জোটকে ‘হ-য-ব-র-ল’ বলে ব্যঙ্গ করলেও বিরোধীদের কর্মকাণ্ডে একটা সুচিন্তিত ‘ছক’ দেখতে পাচ্ছেন স্থানীয় নেতারা।

পক্ষান্তরে, মন্ত্রীর শিবিরের ‘ফরোয়ার্ড’দের অস্ত্র বলতে বাম জমানায় দীর্ঘ অনুন্নয়ন এবং রক্তক্ষরণের ইতিহাস। পঁয়ত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকেও বামেরা কেন গ্রামীণ এলাকায় উন্নয়ন করতে পারেননি, চা-বাগানকে লুটে কোন বাম নেতা কত সম্পদ বাড়িয়েছেন, তাতে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুর ভূমিকাই বা কী— সে সবই প্রচারে তুলে ধরছে তৃণমূল। অশোকবাবুর আমলে কত রাজনৈতিক খুন হয়েছে, তার তালিকাও নানা জায়গায় টাঙিয়ে দিয়েছে তারা। বিরোধীদের জোটকেও খুব গুরুত্ব দিতে রাজি নন গৌতমবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভোটের স্বার্থে জড়ো হলে তাকে দল বলা চলে না। তৃণমূলই মানুষের টিম।’’

ডার্বি-জয়ীর আবিরের রং সবুজ না লাল হয়, দেখতে তৈরি শিলিগুড়ির ময়দান।

gautam deb ashoke bhattacharya direct confrontation siliguri sub-divisional election kishore saha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy