Advertisement
E-Paper

ডেলোর পর দেখা লক-আপে, ভুলের কাটাছেঁড়ায় মগ্ন ওঁরা

শীর্ণ চেহারার মানুষটির পরনে ছেঁড়া পাজামা, ময়লা ফতুয়া। পায়ে ছেঁড়া চটি। গালে কয়েক দিনের না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি। অন্য জনের চেহারা অতটা টসকায়নি। পরিষ্কার করে কামানো গাল। হালকা গোলাপি টি-শার্ট, জি‌ন্‌স। পায়ে দামি চপ্পল। শীর্ণ চেহারা অন্য জনকে বললেন, ‘‘সেই ডেলো পাহাড়ের মিটিংয়ে দেখা হয়েছিল। এত দিন পরে আজ আবার দেখা হল।’’ অন্য জন চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘‘এ কী চেহারা হয়েছে আপনার!’’

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪৪
অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

শীর্ণ চেহারার মানুষটির পরনে ছেঁড়া পাজামা, ময়লা ফতুয়া। পায়ে ছেঁড়া চটি। গালে কয়েক দিনের না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি।
অন্য জনের চেহারা অতটা টসকায়নি। পরিষ্কার করে কামানো গাল। হালকা গোলাপি টি-শার্ট, জি‌ন্‌স। পায়ে দামি চপ্পল।
শীর্ণ চেহারা অন্য জনকে বললেন, ‘‘সেই ডেলো পাহাড়ের মিটিংয়ে দেখা হয়েছিল। এত দিন পরে আজ আবার দেখা হল।’’ অন্য জন চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘‘এ কী চেহারা হয়েছে আপনার!’’
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা। বিচার ভবনের কোর্ট লক-আপ। বছর তিনেকের ব্যবধানে সেখানেই ফের মুখোমুখি সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন এবং রোজ ভ্যালি-কর্তা গৌতম কুণ্ডু।
অনুচ্চ স্বরেই চলছিল কথোপকথন। তবু কোর্ট লক-আপের বাইরে কান পাতলে মোটামুটি স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল দু’জনের গলা। বেশির ভাগটা জুড়েই আক্ষেপ আর হতাশা। দু-এক জন পুলিশকর্মী বা আইনজীবীকেও দেখা গেল, কৌতূহল চেপে রাখতে পারেননি। প্রায় আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা চালাচ্ছেন, কী কথা বলছেন জেলবন্দি দুই লগ্নি-কর্তা।
গৌতম ‘এ কী চেহারা হয়েছে’ বলতেই লক-আপের একধারে গিয়ে বসে পড়লেন সুদীপ্ত। দেখা গেল, গৌতমও বসলেন তাঁর পাশে। সুদীপ্ত বললেন, ‘‘বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। হাঁটুতে খুব যন্ত্রণা হয়।’’ তার পর একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না!’’

গৌতম এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন সুদীপ্তকে। বললেন, ‘‘যা হবার তা হবে! নিজেকে একটু যত্নে রাখুন। মরতে চাইলেই তো আর মরতে পারবেন না! অসুস্থ হয়ে পড়বেন, কষ্ট পাবেন। শরীরের যত্ন নিন।’’

এ বার আর্তনাদের মতো শোনাল সুদীপ্তর গলা। বললেন, ‘‘আপনাকে তো সিবিআই কোনও মামলা দেয়নি! মামলা করেছে ইডি। আপনার জামিন হয়ে যাবে। আমার নামে ১৮২টা মামলা। জামিন হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। তবে একটা কথা এখন বুঝতে পারছি, আমাদের এ বার সব ঘটনা খুলে বলে দেওয়া উচিত।’’

হতাশ দেখাল গৌতমকে। লকআপের পিছনের দেওয়ালে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘সব বলে দিলে আমাকেও তো ১৮২টা মামলা দেবে। তখন আমারও আর জামিন হবে না।’’ সায় দিলেন সুদীপ্ত। বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছেন। আমরা তো বিজনেসম্যান! নেতাদের সঙ্গে ও রকম ভাবে মেলামেশা করা উচিত হয়নি। এই দেখুন না, মিডিয়ার দু’জনকে এমপি করলাম। নেতাদের নানা খরচ জোগালাম। কিন্তু আমার কী হল বলুন?’’ যেন নিজের মনেই অস্ফুটে বলতে থাকেন সুদীপ্ত, ‘‘সংসার ভেসে গিয়েছে। কেউ খোঁজও নেয় না।’’

দম নিতে এ বার একটু থামলেন সারদা-কর্তা। এবং দেখা গেল, তার পরেই সটান গৌতমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তবে আপনি আমার চেয়ে নেতাদের ভালভাবে হ্যান্ডল করেছেন। সেই কারণেই ওরা আপনার বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। আপনি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবেন। আমি তো তা-ও পারব না। বেশিটাই লুঠ হয়ে গিয়েছে। কোথা থেকে ফেরত দেব বলুন? ওরা আপনাকে বেশি কাটতে পারেনি। আমাকে শেষ করে দিয়েছে।’’

ইতিমধ্যে গৌতমের ডাক আসে আদালত থেকে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এজলাসে। মিনিট দশেক পরেই লক-আপে ফিরে এলেন রোজ ভ্যালি কর্তা। বললেন, ‘‘উকিল এখনও আসেননি। আবার পরে যেতে হবে।’’

ফের শুরু হল দু’জনের আলাপচারিতা।

‘‘কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের তিক্ত সম্পর্কের জন্যই আমাদের জামিন হচ্ছে না। কিন্তু দেখুন, আমরা এদের কত রকম ভাবে সাহায্য করেছি। এখন সব মুখ লুকিয়ে রয়েছে। উল্টে নানা ভাবে বলা হচ্ছে, যেন মুখ না খুলি’’— রুক্ষ গলায় বলছিলেন গৌতম।

এই সময়ে আদালতের বাইরে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি। তা শুনে গৌতম বললেন, ‘‘আমার কর্মীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।’’ এ বার যেন আরও মুষড়ে পড়লেন সুদীপ্ত। বললেন, ‘‘ভাল, আপনার সঙ্গে লোকজন আছে। আমার পাশে তো এখন কেউ নেই!’’

কথাবার্তার মধ্যেই লক-আপের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্মী দু’কাপ চা নিয়ে এলেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুদীপ্ত বললেন, ‘‘এখনও আপনার সব জায়গায় খুব কদর রয়েছে। আপনার দৌলতে আজ লক-আপে চা পেলাম। আমাকে এরা কোনও দিন চা দেয় না!’’

ঘড়ির কাঁটা এগোয়। এক সময়ে দু’জনকেই একে একে নিয়ে যাওয়া হয় এজলাসে। দু’জনের আলাদা মামলা। গৌতমকে ১৭ জুন পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল আদালত। সুদীপ্তের জেল হেফাজত হল ১৬ জুন পর্যন্ত। এর কিছু ক্ষণ পরে দুই অর্থলগ্নি সংস্থার সর্বেসর্বাকে তোলা হল আলাদা দু’টি পুলিশ ভ্যানে।

সুদীপ্তকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান রওনা হল আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের উদ্দেশে। প্রেসিডেন্সির পথ ধরল গৌতমের ভ্যান।

Subhasis Ghatak Sudipta Sen Gautam Kundu Chit Fund money abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy