Advertisement
E-Paper

তিনমূর্তির নীরব রণকৌশলেই তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি

মাত্র বছর চারেক আগেও ছবিটা ঠিক এইরকম ছিল। দিল্লিতে ততদিনে কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৯ ০০:৩২
সব মিলিয়ে সংগঠনে জোয়ার এনেছে বিজেপি গত কয়েক বছরে।

সব মিলিয়ে সংগঠনে জোয়ার এনেছে বিজেপি গত কয়েক বছরে।

একটা মণ্ডল মানে ৬০-৭০টা বুথ। প্রায় গোটা দেশে এই হিসেব মাথায় রেখেই চলে বিজেপি। কিন্তু রাজমহল পাহাড় পেরিয়ে পূর্ব দিকে এলেই সব হিসেব যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ২০০-২৫০ বুথ নিয়ে এক একটা মণ্ডল কমিটি তৈরি করতে হচ্ছিল বিজেপিকে। কারণ লোক নেই।

মাত্র বছর চারেক আগেও ছবিটা ঠিক এইরকম ছিল। দিল্লিতে ততদিনে কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-য় দেশ জুড়ে যে মোদী ঝড় বয়েছিল, সে ঝড় বাংলায় খুব বেশি আঁচড় না কাটলেও দু’টো আসন উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল মোদীর ঝুলিতে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দেশ জুড়ে বিজেপির শিকড় ক্রমশ গভীরে যেতে শুরু করলেও বাংলায় সংগঠন বা জনভিত্তি বাড়ছিল না। এমন এক সন্ধিক্ষণেই মোক্ষম সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন অমিত শাহ। হরিয়ানায় প্রান্তিক তৃতীয় শক্তি হয়ে থাকা দলকে ক্ষমতায় টেনে তুলেছিলেন যিনি, সেই কৈলায় বিজয়বর্গীয়কে বাংলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পর্যবেক্ষক হিসাবে। সরিয়ে নিয়েছিলেন কৈলাসের পূর্বসূরি সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে। একা কৈলাস অবশ্য নন, বারবার বাংলায় আসা শুরু করেছিলেন দলের সর্বভারতীয় সহকারি সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিব প্রকাশ। সে সময়ে বোঝা যায়নি মোদীর প্রধান সেনাপতির এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব। খুব স্পষ্টভাবে বোঝা গেল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হতেই।

২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনেও মাত্র ১০ শতাংশে আটকে ছিল বঙ্গ বিজেপির ভোট প্রাপ্তি। সেখান থেকে ২০১৮ ধুন্ধুমার পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি আত্মপ্রকাশ করল রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে। তারপরে এক বছরও কাটল না। প্রায় গোটা দেশকে চমকে দিয়ে বাংলায় ১৮টা লোকসভা আসন জিতে এবং আরও ২টো কান ঘেষে হেরে তূণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে দিল বিজেপি।

আরও পড়ুন: বাবার কাছে হেরে গেলাম, মন্তব্যের পরেই তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড শুভ্রাংশু

তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া কাজ করছিল কিছুটা, সে কথা ঠিক। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটই দিতে না পারার যন্ত্রণা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সে-ও বাস্তব। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের হাওয়াও যে বইতে শুরু করেছিল, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাওয়া সবকটা ফ্যাক্টর শুধুমাত্র বিজেপির পালেই হাওয়া জোগাল কেন? কেন কংগ্রেস বা বামেরা সে হাওয়া টানতে পারল না নিজেদের পালে? এই প্রশ্নের উত্তর আতস কাচে খোঁজার চেষ্টা করলেই চোখে ধরা পড়ছে কৈলাস-শিব প্রকাশদের ভূমিকা।

সঙ্ঘ ও বিজেপির হয়ে ভারতের নানা প্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে ঘুঁটি সাজিয়ে আসা এই দুই গৈরিক সৈনিকের নেতৃত্বে বাংলায় ঠিক কী ভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে বিজেপির সংগঠন, গেরুয়া শিবিরের সাংগঠনিক অগ্রগতির খাতাপত্রে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালেও লোকাভাবে বাংলায় মাত্র ৪৫২টা মণ্ডল কমিটি ছিল বিজেপির। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক একটা ব্লক জুড়ে এক একটা মণ্ডল। আর এখন সেই সংখ্যাটা গিয়ে পৌঁছেছে ১২৮০-তে। অর্থাৎ চার বছরে প্রায় তিনগুণ। শক্তিকেন্দ্র কী? জানতই না বাংলার বিজেপি। প্রথমে কৈলাস-শিব প্রকাশ এবং পরে তাঁদের সঙ্গে অরবিন্দ মেনন মিলে শক্তিকেন্দ্র চেনালেন বাংলাকে। কোথাও তিন-চারটে, কোথাও পাঁচটা, কোথাও আর কয়েকটা বেশি বুথ একসঙ্গে এনে রাজ্য জুড়ে জন্ম দিলেন মোট ১২৪০৭টি শক্তিকেন্দ্রের। সেগুলোর দেখভাল, বুথস্তরের কর্মকর্তাদের একসঙ্গে ডেকে কর্মসূচি গ্রহণ এবং ক্রমশ কার্যকর্তার সংখ্যাবৃদ্ধি করার জন্য নিয়োগ করলেন ১০২৬৬ জন শক্তিকেন্দ্র প্রমুখ। রাজ্যে মোট বুথের সংখ্যা ৭৮৭৪১। শক্তিকেন্দ্রের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়, প্রায় সব বুথকেই বিজেপি গত চার বছরে নিয়ে আসতে পেরেছে একেবারে নীচের স্তরের এই সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায়।

আরও পড়ুন: পোস্টাল ব্যালটে রাজ্যের ৩৯ কেন্দ্রেই এগিয়ে বিজেপি! সরকারি কর্মীদের ডিএ-‘বিদ্রোহে’র ছাপ ভোটবাক্সে?

মুকুল রায়ের মতো নেতাদেরকে দলে স্বাগত জানানো ও বড়সড় দায়িত্ব দেওয়া, অর্জুন সিংহ বা সৌমিত্র খাঁদের জন্য চটজলদি দরজা খুলে দেওয়া এবং ভোটে লড়ার সুযোগ দিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য দল থেকে বিজেপিতে সামিল হওয়া আরও বেশ কিছু নেতাকে বসিয়ে না রেখে নানা ভাবে কাজে লাগানো— কাজে এসেছে এই সব স্ট্র্যাটেজিও।

শুধু নীচের স্তরের সাংগঠনিক কাঠামো বানিয়ে অবশ্য থেমে থাকেননি বিজেপি নেতারা। রাজ্যকে পাঁচটা জোনে ভাগও করে দিয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই— উত্তরবঙ্গ, নবদ্বীপ, রাঢ়বঙ্গ, হুগলি-মেদিনীপুর, কলকাতা। এক একটি জোনের দায়িত্বে এক এক জন রাজ্যস্তরের নেতা। এছাড়া ব্লকে ব্লকে ‘বিস্তারক’দের পাঠানো, প্রত্যেকটি লোকসভা কেন্দ্রের জন্য একজন করে ‘পালক’ নিয়োগ করা, এবং সর্বভারতীয় স্তর থেকে আসা পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে জোনাল স্তরের নেতাদের নিয়মিত নানা রুদ্ধদ্বার ও প্রকাশ্য কর্মসূচিতে পাঠাতে থাকা বাংলার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে— এইসব মিলিয়ে এ রাজ্যে বিজেপির সংগঠনের চাকাটাকে গড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। নামমাত্র সংগঠন কয়েক বছরেই পরিণত হয়েছিল দৃশ্যমান বাস্তবতায়। আর অস্তিত্বশীল থাকা সত্ত্বেও সংগঠনের যে সব শাখা অচল থাকতে থাকতে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল, সেগুলোকে দ্রুত সচল করে তুলেছিলেন কলকব্জায় উৎসাহের তেল জুগিয়ে। ফলাফল সবার চোখের সামনে। রাজ্যের শাসকদলকে চমকে দিয়ে যাবতীয় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নিজেদের দিকে টেনে নিল বিজেপি। রকেট গতির উত্থানে বাংলার ১২৯টা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দিল মোদী-শাহের দল।

মহিলা মোর্চা, সংখ্যালঘু মোর্চা, তফশিলি মোর্চা, সরকারি কর্মচারী পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, যুবমোর্চা— একের পর এক শাখা সংগঠনকে গত কয়েক বছরে যে ভাবে সচল করে তুলেছে এ রাজ্যের গেরুয়া শিবির, তা চোখে পড়ার মতো রাজনৈতিক ঘটনা। মহিলা মোর্চার সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় বা যুব মোর্চার সভাপতি দেবজিৎ সরকাররা এতটাই সামনের সারিতে উঠে এসেছেন গত কয়েক বছরে যে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে টিকিটও পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা। মহিলা মোর্চার লকেট চট্টোপাধ্যায় হুগলিতে জিতে লোকসভাতেও চলে গিয়েছেন। শ্রীরামপুরে যুব মোর্চার দেবজিৎ জেতেননি ঠিকই, কিন্তু ১০ বছরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জোরদার লড়াইয়ের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।

সব মিলিয়ে সংগঠনে জোয়ার এনেছে বিজেপি গত কয়েক বছরে। স্বাভাবিক ভাবেই জোয়ার এসেছে জনভিত্তিতেও। বিজেপি এ রাজ্যে যে ফলাফল করল, তার নেপথ্যে একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত সংগঠনের ভূমিকাও যে যথেষ্ট, তার প্রমাণ মিলেছে বিজেপির জয়-পরাজয়ের বিন্যাসেও। রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে থাকা উত্তরবঙ্গ এবং নির্মল কর্মকারের নেতৃত্বে থাকা রাঢ়বঙ্গ— এই দুই জোনেই নিজেদের সংগঠনকে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পেরেছিল বিজেপি। ফলাফল সবচেয়ে ভাল এই দুই জোনেই।

উত্তরবঙ্গ জোনের ৮ আসনের মধ্যে সাতটিই জিতল বিজেপি। রাঢ়বঙ্গের ৮ আসনের মধ্যে দখল করল ৫টি। উল্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। আবিরের উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসতেই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে কৈলাস-শিব প্রকাশ-মেননদের নির্ভুল রণকৌশলের ক্যারিশমা|

Election Results 2019 Lok Sabha Election 2019 লোকসভা ভোট ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy