Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিধানসভাতেও তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস বিজেপির, মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রেও কোনও রকমে এগিয়ে তৃণমূল

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে অবশ্য রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পাহাড় থেকে জঙ্গল, সর্বত্রই ধস নেমেছে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৯ ১৭:০০
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে এই মুহূর্তে রাজ্য বিধানসভা ওয়াড়ি আসন বিন্যাসেও ভেঙে পড়ার মুখে তৃণমূলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। লোকসভা নির্বাচনে কোন বিধানসভা থেকে কারা লিড পেয়েছে, নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২৯৪ সদস্যের রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল এখনও এগিয়ে থাকলেও দুরন্ত গতিতে উঠে আসছে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে রাজ্যে তৃণমূল এগিয়ে ১৬৪টি বিধানসভা আসনে, অন্য দিকে বিজেপি এগিয়ে আছে ১২১টি আসনে। মুখ্যমন্ত্রীর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ভবানীপুরেও কোনও রকমে নামমাত্র ভোটে নিজের লিড ধরে রাখতে পেরেছে তৃণমূল।

লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী মাত্র তিন বছরে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন তো বটেই, ২০১৬ সালের শেষ বিধানসভা নির্বাচনেও গোটা রাজ্যে নিজের নিরঙ্কুশ একাধিপত্য বজায় রেখেছিল তৃণমূল। সেই নির্বাচনে রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১১টি আসনে জিতে বিরোধীদের প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত করে দ্বিতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন বছর আগের সেই বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪টি আসন। বামফ্রন্টের ঝুলিতে ছিল ৩২টি আসন। আর গোটা রাজ্যে বিজেপির জুটেছিল সাকুল্যে তিনটি আসন।

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে অবশ্য রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পাহাড় থেকে জঙ্গল, সর্বত্রই বিপুল ভাবে উঠে এসেছে বিজেপি। অন্য দিকে তিন বছরের মধ্যে ২১১টি থেকে কমে ১৬৪ হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের আসনসংখ্যা। অর্থাৎ আসন কমল ৪৭টি। পাশাপাশি তিনটি আসন থেকে বেড়ে এই মুহূর্তে রাজ্যের ১২১টি আসনে এগিয়ে বিজেপি। শোচনীয় অবস্থা কংগ্রেসেরও। ৪৪ থেকে কমে তারা এগিয়ে এখন মাত্র ন’টি আসনে। অন্য দিকে তিন বছর আগে রাজ্য বিধানসভায় ৩২টি আসনে জিতে কোনও রকমে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখলেও সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে রাজ্যের একটি আসনেও এগিয়ে নেই বামফ্রন্ট। এই মুহূর্তে বিধানসভা ভোট হলে এবং লোকসভা নির্বাচনের ট্রেন্ড বজায় থাকলে রাজ্য বিধানসভায় কোনও চেয়ারই বরাদ্দ থাকবে না বামেদের জন্য।

রাজ্যে গেরুয়া ঝড়ের দাপট থেকে রেহাই পায়নি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুক ভবানীপুরও। বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জিতেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সেই নির্বাচনে পঁচিশ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি। সেই ভবানীপুরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক পিছনেই এখন বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই বিধানসভা আসনে তৃণমূল পেয়েছে ৬১ হাজার ১৩৭টি ভোট। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৫৭ হাজার ৯৬৯টি ভোট। অর্থাৎ, নিজের কেন্দ্রেও কোনও রকমে তিন হাজার ১৬৮ ভোটের নামমাত্র ব্যবধানে এগিয়ে তৃণমূলনেত্রী।

শুধু ভবানীপুর নয়, কলকাতা থেকে একটিও লোকসভা আসনে জিততে না পারলেও শহরের বেশ কয়েকটি বিধানসভায় এখন এগিয়ে বিজেপিই। লোকসভা ভোটের নিরিখে এই মুহূর্তে বিধাননগর, রাজারহাট-গোপালপুর, রাসবিহারী, জোড়াসাঁকো এবং শ্যামপুকুরে এগিয়ে বিজেপি। যদিও দমদম, রাজারহাট-নিউটাউন, কসবা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, বেহালা পূর্ব এবং পশ্চিম, মহেশতলা, বজবজ, মেটিয়াবুরুজ, কলকাতা বন্দর, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ, চৌরঙ্গি, এন্টালি এবং বেলেঘাটায় এগিয়ে তৃণমূল।

আরও পড়ুন: কলকাতায় পিছিয়ে ৫০ কাউন্সিলর, মমতার বাড়ির ওয়ার্ডেও পদ্মে ঢাকল ঘাসফুল

ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় প্রতিটি জনসভায় পাহাড় আর জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর দাবি করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উন্নয়নকে হাতিয়ার করে গোর্খা আন্দোলনের পাশাপাশি মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলতেন তিনি। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে অবশ্য পাহাড় আর জঙ্গলমহলে তৃণমূলের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। দার্জিলিং, কার্শিয়াং আর কালিম্পঙ, পাহাড়ের এই তিনটি আসনেই তৃণমূলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি।

একই অবস্থা জঙ্গলমহলেও। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া আর পুরুলিয়া মিলিয়ে জঙ্গলমহলের মোট ১৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২টিতেই এগিয়ে বিজেপি। কোনও রকমে দু’টি আসনে লিড ধরে রেখে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে তৃণমূল। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে জঙ্গলমহলের নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, গড়বেতা, মেদিনীপুর, বান্দোয়ান, বলরামপুর, বাঘমুন্ডি, জয়পুর, পুরুলিয়া, রানিবাঁধ, রাইপুরে এগিয়ে বিজেপি। অন্য দিকে তৃণমূল এগিয়ে শুধু মানবাজার আর বিনপুরে।

শুধু পাহাড় নয়, উত্তরবঙ্গ জুড়েই ধস নেমেছে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদহ (উত্তর) এবং মালদহ (দক্ষিণ), এই আটটি লোকসভা আসনের ৫৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি এগিয়ে আছে ৩৬টি আসনে, তৃণমূল ১৪টি আসনে এবং কংগ্রেস ছ’টি আসনে।

পাহাড়, জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও দক্ষিণবঙ্গে এখনও আধিপত্য জারি আছে তৃণমূলের। বসিরহাট, জয়নগর, মথুরাপুর, ডায়মন্ডহারবার, উলুবেড়িয়া, কাঁথি এবং তমলুক, এই সাতটি লোকসভা আসনের ৪৯টি বিধানসভা আসনের একটিতেও এগিয়ে নিই বিজেপি বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ, দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী সাম্রাজ্যে এখনও দুর্ভেদ্য তৃণমূলের গড়।

আরও পড়ুন: বহু মুসলিমপ্রধান আসনেও সাফল্য এসেছে বিজেপির, জানেন?

২০১১ তে ৩৪ বছরের বাম রাজত্বের পতনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই। রাজ্য জুড়ে আন্দোলনের পাশাপাশি সেই নির্বাচনে বাম ভোটব্যাঙ্কে ধস নামিয়ে ১৬টি আসন জিতেছিল তৃণমূল। তৃণমূলের সেই উত্থান আটকাতে ব্যর্থ হয়েছিল বামফ্রন্ট। দু’বছর পরেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ধরাশায়ী করে রাজ্যে ঐতিহাসিক পালাবদল ঘটিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনেও ১৮টি আসন জিতে তৃণমূলের ঠিক পিছনেই আছে বিজেপি। দু’বছর পরেই ফের বিধানসভা নির্বাচন। তাহলে কি দশ বছর তৃণমূল শাসনের পর ফের আরেক পালাবদলের মুখোমুখি হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ? নাকি রাস্তায় নেমে বিজেপির বিজয়রথে লাগাম পড়াতে সফল হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? যাই হোক, এটা নিশ্চিত যে আগামী দু’বছর জমজমাটই থাকছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE