Advertisement
E-Paper

ম্যান অব দ্য ম্যাচ কমিশন, আমি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে চেয়েছিলাম: ঝাঁঝালো আক্রমণে মমতা

ভোটের ফলাফল পর্যালোচনার জন্য নিজের বাসভবন সংলগ্ন কার্যালয়ে এ দিন বৈঠক ডেকেছিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। লোকসভা নির্বাচনের সব প্রার্থীকেই ডাকা হয়েছিল সেখানে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০০:০১
সাংবাদিক সম্মেলনে আগাগোড়া আক্রমণাত্মক থাকার চেষ্টাই করতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ছবি: পিটিআই।

সাংবাদিক সম্মেলনে আগাগোড়া আক্রমণাত্মক থাকার চেষ্টাই করতে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ছবি: পিটিআই।

ছিলেন অন্তরালে। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে সংবাদ মাধ্যমের সামনে এলেন। আসন কমলেও ভোট বেড়েছে তাঁর— আগের লোকসভা নির্বাচনের হিসেব তুলে ধরে এমনই দাবি করলেন। প্রবল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোর অভিযোগ তুললেন বিজেপির বিরুদ্ধে। সরাসরি তুললেন টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ। আর তার সঙ্গে জুড়লেন ‘সেটিং’ তত্ত্ব। কমিশনের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন রাজ্যে বুথ লুঠ করেছে বিজেপি আর বাংলায় বিভিন্ন আসনে এক লক্ষ করে ভোট ‘প্রোগ্রামিং’ করে রাখা হয়েছিল— তাঁর সন্দেহ এই রকমই।

শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা কিছু সংবাদ মাধ্যমকে বললেন ভোট নিয়ে, তার সারকথা এই। ভোটের ফলাফল পর্যালোচনার জন্য নিজের বাসভবন সংলগ্ন কার্যালয়ে এ দিন বৈঠক ডেকেছিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। লোকসভা নির্বাচনের সব প্রার্থীকেই ডাকা হয়েছিল সেখানে। ডাকা হয়েছিল দলের জেলা সভাপতি এবং পর্যবেক্ষকদের। ডাকা হয়েছিল সিনিয়র নেতাদেরও। পর্যালোচনা শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বললেন, তাতে কিন্তু তৃণমূলের বা তাঁর সরকারের তরফে কোনও খামতির স্বীকারোক্তি রইল না। বিজেপির কাছে বড় ধাক্কা খাওয়ার অজুহাত হিসেবে ঘুরেফিরে বার বারই বরং উঠে এল নানা রকম চক্রান্ত ও অশুভ আঁতাতের তত্ত্ব।

শনিবারের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রায় আগাগোড়াই আক্রমণাত্মক থাকার চেষ্টা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কোথাও মনে হল তিনি বিরক্ত, কোথাও মনে হল তথাকথিত চক্রান্তের সামনে তিনি অসহায় বোধ করছেন, কোথাও আবার রয়ে গেল একটু অভিমানের সুর। তিনি জানালেন, এ দিনের বৈঠকের শুরুতেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

আরও পড়ুন: শহরে সমানে সমানে, গ্রামেও তৃণমূলকে জোর টক্কর বিজেপির

বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, তাঁকে গত পাঁচ মাস কোনও কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘আমি এ রকম আগে কখনও দেখিনি। পাঁচ মাস ধরে কোনও কাজ করতে গেলেই বলছে, সব নির্বাচন কমিশনের অধীনে। সারা ভারতে আর কোথাও হয়েছে কি না জানি না, কিন্তু বাংলায় তো হয়েছে।’’ কণ্ঠস্বরে তীব্র ঝাঁঝ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘পুরো কেন্দ্রীয় বাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, নির্বাচন কমিশন পুরো ওদের (বিজেপির) হয়ে কাজ করেছে। কেউ বলুক ছাই না বলুক, ঘটনা তো সত্য!’’

দেখুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলন

তবে এত কিছু করেও তৃণমূলকে বিজেপি খুব একটা ধাক্কা দিতে পেরেছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন না। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের আসন হয়তো কমেছে, কিন্তু ভোট বেড়েছে।’’ ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে চোখ রাখলে দেখা যাবে তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তির হার অবশ্যই বেড়েছে। কিন্তু তার পরে ২০১৬ সালে যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল, তাতে তৃণমূলের পাওয়া ভোট শতাংশে যদি চোখ রাখা যায়, তা হলে কিন্তু ভোট এ বার কমেছে। সে প্রসঙ্গে কারও কাছ থেকে কোনও মন্তব্য মেলেনি।

আরও পড়ুন: ব্যাটন ছাড়তে চাই: সায়ন্তনের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে জল্পনা তীব্র, সক্রিয় হচ্ছে আরএসএস

নির্বাচনী ফলাফলের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘পুরোপুরি হিন্দু-মুসলমান করা হয়েছে। আমি এটা মানি না, আমি এই থিওরি মানি না। আমি ওদের অভিনন্দন জানিয়েও বলছি, আমি এই থিওরি মানি না। এতে যদি আমায় একা থাকতে হয়, আমি একা থাকতেও রাজি আছি। কিন্তু আমি হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টানে ভোট ভাগাভাগি মানি না।’’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, শুধু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণেই বিজেপি থামেনি। হাজার হাজার কোটি টাকা বিজেপি ছড়িয়েছে বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘এই নির্বাচনে যে টাকা খরচ করেছে বিজেপি, যে কোনও কেলেঙ্কারিকে হারিয়ে দেবে।’’ এই সব কথা বলতে গেলেই তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই বা ইডি-কে ব্যবহার করা হতে পারে— এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তবে পরক্ষণেই জানান যে, কেন্দ্রীয় এজেন্সির ভয়ে তিনি চুপ করে থাকবেন না।

কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে টাকা ঢোকানো এবং ঘরে ঘরে টাকা বণ্টন হয়েছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ। কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে এবং কলকাতা বিমানবন্দর যে কমিশনারেটের অধীনে, সেই বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিয়ে টাকার আদান-প্রদানের পথ প্রশস্ত করা হয়েছিল বলে তাঁর ইঙ্গিত।

তৃণমূল চেয়ারপার্সন এ দিন বলেন, ‘‘পুরো জরুরি অবস্থা তৈরি করে নির্বাচন করেছে। খুব অপমানের মধ্যে দিয়ে সরকার চালিয়ে এসেছি।’’ এই প্রসঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইস্তফার ইচ্ছার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট, টাকার দোষে দুষ্ট নির্বাচনকে আমি মেনে নিতে পারছি না। তাই আমি আজ বৈঠকের শুরুতেই বলেছিলাম, আমি আর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে চাই না।’’ কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাব দল মানেনি বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন যে, তিনি কিছুতেই দলকে নিজের কথা বোঝাতে পারেননি, তাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুধু বাংলা নয়, অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচন নিয়েও যে তাঁর সন্দেহ রয়েছে, সে কথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন। গুজরাত, রাজস্থান, দিল্লি, হরিয়ানা-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে সব আসন বা প্রায় সব আসন বিজেপির ঝুলিতে গেল কী ভাবে? প্রশ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভোট লুঠ না করলে কি এমনটা সম্ভব? প্রশ্ন তাঁর।

‘প্রোগ্রামিং’ তত্ত্বও এ দিন বেশ জোর দিয়ে তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা অনেক কিছু শুনতে পেয়েছি, পাচ্ছি। যেখানে আমরা এক লক্ষের কমে হেরেছি, সেখানে আমার সন্দেহ আছে। আমার নিজের ধারণা, প্রোগ্রামিং একটা করা ছিল। আমাকে তিন মাস আগে থেকে আমলা মহলের অনেকে বলেছিলেন।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেটিং একটা হয়েছে। সেটিংটা কী করে হল, কী করে হল? দেখা যাক।’’

বিজেপির পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও এ দিন তীব্র আক্রমণ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি একা নন, সম্মিলিত বিরোধী শিবির বার বার কমিশনে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে, কিন্তু কোনও অভিযোগকেই কমিশন গুরুত্ব দেয়নি— বিরক্তি নিয়ে এ দিন বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েও কোনও সুরাহা হয়নি— আক্ষেপ তাঁর। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাতেও যে তিনি সন্তুষ্ট নন, তাও এ দিন বুঝিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন কমিশনের বিরুদ্ধেই। তাঁর কথায়, ‘‘এ বার ইলেকশন কমিশন ওপেন গেম খেলেছে, ইলেকশন কমিশন হল এই নির্বাচনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ।’’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এ দিন এক বারের জন্যও বুঝতে দিতে চাননি যে, নির্বাচনের এই ফলাফলে তিনি আশাহত। সাংবাদিক সম্মেলনের প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন স্বভাবসিদ্ধ তেজ। কোনও প্রসঙ্গেই ব্যাকফুটে গিয়ে খেলার কথা ভাবেননি, আক্রমণাত্মক মেজাজে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যাবতীয় অস্বস্তি। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকেই কখনও উঁকি দিয়েছেন এক অভিমানী মমতা। যিনি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন অথবা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের প্রসঙ্গ টেনে বলছেন, ‘‘একটু বেশি কাজ করে ফেলেছিলাম মনে হচ্ছে। এ বার একটু দলটা বেশি করে করব।’’ কখনও দেখা দিয়েছেন ঈষৎ সংশয়ে থাকা মমতা। যিনি দাবি করছেন, চক্রান্ত করে তাঁর দলকে অনেক আসনে হারানো হয়েছে। আবার সে সব ঠেলেই আচমকা তে়ড়েফুঁড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে এক বেপরোয়া মমতাকেও। যিনি বলতে পারেন, ‘‘আমার চেয়ারকে প্রয়োজন নেই, আমাকে চেয়ারের প্রয়োজন।’’

Lok Sabha Election 2019 Election Results 2019 Mamata Banerjee TMC Working Committee Meeting লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় Video
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy