চৌমুহার সেই বটতলা। যেখানে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল বিরোধীদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করে দেব...।’’ কলকাতা হাইকোর্টে তাপস-কাণ্ডের রায় ঘোষণা হওয়ার পরে নাকাশিপাড়ার গ্রামটির সেই বটতলায় গিয়ে দাঁড়াতেই পথ আটকালেন বছর পঁচিশের এক যুবক। কানে ফোন তুলে বললেন, “দাদা, মিডিয়া এসেছে। কী করব?” হয়তো দাদার নির্দেশেই তারপর থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে নজর রাখলেন সাংবাদিকদের উপর।
সময় দুপুর সাড়ে বারোটা। ইতিমধ্যেই নাকাশিপাড়া থানার একটি পুলিশ ভ্যান গ্রামে টহল দিয়ে গিয়েছে। হাইকোর্ট যে সাংসদের নামে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশকে, রাজ্যবাসী তা জেনে গিয়েছেন। চৌমুহার অনেকেই তখনও রায়ের কথা জানেন না। পুরুষরা কাজে গিয়েছেন। মহিলা সাংবাদিকদের দেখে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসার বদলে, দ্রুত ঢুকে গেলেন ঘরে। গ্রামের পরিবেশ থমথমে।
অথচ মাস তিনেক আগে ছবিটা ছিল উল্টো। ১৪ জুন চৌমুহা ছাড়া আরও চারটি গ্রামে আপত্তিকর মন্তব্য করার পরেও তাপস পালের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চৌমুহা গ্রামে এসে তা নিয়ে প্রশ্ন করলে কার্যত ফুঁসে উঠেছিলেন মহিলারা। প্রশ্ন তুলেছিলেন, “মহিলাদের এতবড় অপমান মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিলেন কী ভাবে?” তাপস পালের শাস্তিও দাবি করেন তাঁরা। সেই মহিলারাই কেন সাংসদের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের নির্দেশের দিন কোনও কথা না বলে সরে যেতে চান?
চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে এক মাঝবয়সী মহিলা গলা নামিয়ে বললেন, “এর আগে তোমাদের কাছে অনেক কথা বলেছি। তার জন্য কম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। এলাকার তৃণমূলের লোকজন বাড়ির পুরুষদের রাস্তায় শাসিয়েছে। সবাই খুব ভয়ে ভয়ে আছি।” হাইকোর্টের এত বড় রায়ের পরেও কিছু বলবেন না? পাশ থেকে আর এক মহিলা বলেন, “আবার মুখ খুলে বিপদে পড়ব নাকি? আমাদের তো গ্রামে থাকতে হবে।”
ইতিমধ্যে গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের সঙ্গে বছর পঁচিশের ওই যুবকও। কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় সকলেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। তাঁরা সাংবাদিকদের বলেন, “এরা সব মিথ্যে বলবে। আমাদের কথা শুনবেন, চলুন।” ততক্ষণে অবশ্য মাঠ থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন এলাকার লোকজন। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় তৃণমূলের ওই কর্মীদের। কথা বলতে বলতে তাঁরা গ্রামের ভিতরে সরে গেলে, নাম গোপন রাখার শর্তে মুখ খুললেন কয়েকজন মহিলা। বললেন, “তাপস পাল তো বলে চলে গেলেন। ভুগতে হচ্ছে গোটা গ্রামকে।” গ্রামের পুরুষরা অবশ্য অতটা রাখঢাক রাখছেন না। গ্রামের বৃদ্ধ ভিকু শেখ বলছেন, “তাপস পাল আমাদের গ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমাদের মেয়েকে রেপ করানোর হুমকি দিয়ে গেল, অথচ আমাদের টাকাতেই সরকার তাপস পালের হয়ে মামলা লড়ছে।”
আদালতের নির্দেশ শুনে কী বলছে চৌমুহা? ভিকু শেখ বললেন, “আমরা খুশি। গোটা চৌমুহা ওর শাস্তির অপেক্ষায় আছে।” বটতলার কাছেই বাঁশের মাচায় বসেছিলেন জনাকয়েক যুবক। তাঁদের ক্ষোভ, “সিআইডি দিয়ে কী হবে? পাড়ুই, সারদায় সবাই তো সিআইডির ভূমিকা দেখল। সিবিআই হলেই ভাল হত।”
একই প্রতিক্রিয়া জয়া সরকারের। বছর বাহান্নর এই মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতেই তাপস পালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এলাকায় বিজেপি নেত্রী বলে পরিচিত জয়াদেবী বলেন, ‘‘সিআইডি রাজ্য সরকার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত। বুঝতে পারছি না তদন্ত আদৌ নিরপেক্ষ হবে কি না।” তিনিও সিবিআই তদন্ত দাবি করেন।
পুলিশের উপর আস্থা নেই কেন? জয়াদেবী জানান, চৌমুহা-সহ নাকাশিপাড়ার চারটি গ্রামে তাপসবাবুর হুমকির ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর পয়লা জুলাই তিনি তাপস পালের বিরুদ্ধে নাকাশিপাড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি অভিযোগটিকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার আর্জি জানালেও পুলিশ জেনারেল ডায়েরি করেই দায় সারে। জয়াদেবীর দাবি, “ডায়েরির ভিত্তিতে পুলিশ কোনও তদন্তই করেনি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। নথিভুক্ত হয়নি আমার বয়ান।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, ডায়েরি করার পরে ওই থানার এসআই শুভময় সাহা মণ্ডলকে এনকোয়ারি অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ২ জুলাই শুভময়বাবু চৌমুহা যান। পুলিশ সূত্রে খবর, তিনি এলাকার পরিস্থিতি ‘শান্ত’ ও ‘স্বাভাবিক’ বলে জানান। পুলিশ তাপস পালের বক্তব্যের অসংশোধিত ভিডিও রেকর্ড চেয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে চিঠি পাঠায়। পুলিশের দাবি, ওই চ্যানেল তাদের ভিডিও দেয়নি। জেলা পুলিশের একটি মহলের দাবি, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ, ডিভিসন বেঞ্চে দুই বিচারপতি মতপার্থক্য ইত্যাদি চলতে থাকায় তাপস পালের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর করার বিষয়েও টালবাহানা চালাতে থাকে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy